ফেনীতে বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ, আক্রান্ত বেশি শিশুরা
১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:২৭
ফেনী থেকে ফিরে: বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে ফেনীতে বাড়তে শুরু করেছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। এছাড়াও পেটে ব্যথা, জ্বর ও চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন অনেকেই। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু। শুধুমাত্র শহর এলাকা থেকেই নয়, ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা থেকেও রোগীরা আসছে জেলার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। একইসঙ্গে বিভিন্ন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সেও ভর্তি হচ্ছে রোগী।
ফেনী জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মাঝে শিশুদের সংখ্যা বেশি। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে শনিবার (৩১ আগস্ট) ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চালু করা হয়েছে নতুন ইউনিট। এখন পর্যন্ত বন্যা পরবর্তী নানা পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি হিসেবে আছে পর্যাপ্ত ওরস্যালাইন।
সরেজমিনে শনিবার (৩১ আগস্ট) সকালে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখা যায়, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন বয়সী রোগীদের অপেক্ষা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও রোগীদের ভিড় দেখা যায়। হাসপাতালের মূল কমপ্লেক্সে নতুন রোগী ভর্তি করানো সম্ভব না হওয়ায় নতুন ভবনে রোগীদের পাঠানো হচ্ছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২১ আগস্ট থেকে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় রোগীদের সাময়িকভাবে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় স্থানীয় কয়েকটি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালটির নিচতলার প্রতিটি কক্ষ ডুবে ছিল। ডায়রিয়া ওয়ার্ডটিও পানিতে ডুবে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পানি নামার পর পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি রোগীর সেবাও চলছে। এখন পরিষ্কার করে ওখানেই রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
ধীরে ধীরে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় হাসপাতাল প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে রোগী ভর্তি শুরু করা হয় বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও জানান তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ১৮ শয্যার বাইরেও মেঝেতে শয্যার ব্যবস্থা করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শনিবার (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত হাসপাতালে ১১২ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে উপচে পড়া ভিড়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জেলা শহরের হাসপাতালটি মোট ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হলেও শনিবার (৩১ আগস্ট) দিনও ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি।
হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল সারাবাংলাকে বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে বিভিন্ন ধরণের রোগীরা আসছে চিকিৎসা নিতে। এর মাঝে ডায়রিয়া আক্রান্ত যে রোগীরা আসছে তাদের মাঝে শিশুদের সংখ্যা বেশি।
তিনি বলেন, শনিবার (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত হাসপাতালে ৫১৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মাঝে অনেকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরছে আবার নতুনভাবে রোগী ভর্তি হচ্ছে। শুধুমাত্র বিগত ২৪ ঘণ্টায় ২৫৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন যার মাঝে ১১২ জনই ডায়রিয়া আক্রান্ত। অর্থাৎ হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া রোগীর প্রায় ৪৪ শতাংশই ডায়রিয়া আক্রান্ত।
হাসপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগে বেড়েছে রোগীর চাপ
ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে শুধুমাত্র শুক্রবার (৩০ আগস্ট) থেকে শনিবার (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৬৭ জন। এছাড়া বহির্বিভাগে ৮০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর আগে, বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) থেকে শুক্রবার (৩০ আগস্ট) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটির বহির্বিভাগে ৪২০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়াও এই ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৬৩ জন।
রোগী বেড়েছে ফেনী জেলার অন্যান্য স্থানেও
শুধুমাত্র ফেনী সদর উপজেলা নয়, জেলা শহরটির অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এর মাঝে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি।
প্রসঙ্গত, ফেনী জেলার আওতায় থাকা ছয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও পানিবন্দী ছিল। তবে পানি নেমে যাওয়ার পরে বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে বলে দাবি করেছেন সিভিল সার্জন মো. শিহাব উদ্দিনের।
ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল সহ মোট পাঁচটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে শনিবার (৩১ আগস্ট) সকাল ৮টা পর্যন্ত ৫৪৫ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ভর্তি হয়ে। এর মাঝে ২৭২ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৫০ শতাংশের কাছে।
সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯ জন, পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন, ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাত জন, ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৮ জন ও দাগনভুইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৬ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী শনিবার (৩১ আগস্ট) সকাল ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?
ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজি বন্যা পরবর্তী সময়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ডা. মোবারক হোসেন দুলাল।
তবে আবুল খায়ের মিয়াজি সারাবাংলাকে বলেন, আমি প্রতিনিয়ত খবর রাখছি প্রতিষ্ঠানের। বন্যার শুরু থেকেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মাঝে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের আপাতত স্যালাইন বা অন্যান্য ওষুধ পত্রের তেমন সঙ্কট নেই। তবে আমরা দ্রুতই রিকুইজিশন দিয়ে নতুনভাবে ওষুধ নিয়ে আসবো।
তিনি বলেন, রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়াতে আমরা নতুন ভবনের একটি ফ্লোরেও ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি। এছাড়াও চর্মজনিত নানা রকমের রোগ নিয়ে রোগীরা আসছেন। আমরা তাদেরও সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগেও রোগীর চাপ সামাল দিয়ে সেবা দিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
জেলা সিভিল সার্জন মো. শিহাব উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, বন্যার পানি কমে যাওয়ার পরে বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে রোগীর চাপ বেড়েছে। একদিকে পানিবাহিত নানা রোগ আর অন্যদিকে নানা রকমের চর্মরোগ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। তবে আমরা পরিস্থিতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাল দিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
ডায়রিয়ার স্যালাইন এবং ওআরএসের সংকট আপাতত তেমন নেই। তবে আমরা আরও নতুন চাহিদাপত্র দেবো পরিস্থিতি অনুযায়ী। আশা করছি সেগুলোও খুব দ্রুত পেয়ে যাবো আমরা-যোগ করেন ফেনী জেলার সিভিল সার্জন।
এ দিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে নানা ধরণের রোগ নিয়ে হাসপাতালে রোগীরা আসছেন। আমরাও আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কী কী ক্ষতি হয়েছে এর একটা তালিকা করে পাঠাতে বলেছি সিভিল সার্জনদের। আশা করছি সেটা হাতে পেলে আমরা আরও বিশদ ধারণা পাবো পরিস্থিতি সম্পর্কে।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে ওআরএস ও স্যালাইন সরবরাহ করেছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আরও স্যালাইন যোগাড়ের চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, বন্যা পরবর্তী সময়ে শারীরিক নানা সমস্যার পাশাপাশি মানসিক ট্রমাও দেখা দিতে পারে। তবে আমরা আগে শারীরিকভাবে নানা রোগে আক্রান্তদের সবাইকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে চাই। এরপরে আমরা যদি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো সমস্যা সামনে আসে তখন সেটা নিয়েও কাজ শুরু করবো অবশ্যই।
সারাবাংলা/এসবি/ইআ
ডায়রিয়া ওয়ার্ড ডায়রিয়া রোগী ডায়রিয়ার প্রকোপ ফেনী বন্যা শিশু রোগী