একদলীয় হওয়ায় নির্বাচনে কারচুপি করার প্রয়োজন ছিল না: বিদায়ী সিইসি
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫৯
ঢাকা: ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ তার মেয়াদের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিদায় নিতে যাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বলেছেন, এসব নির্বাচন একটি দলের ভেতরেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার পাঠানো, কিছু উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একই দিনে তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি দিয়ে পাঁচ-ছয়টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকতাদের ব্যাপক রদবদল ইত্যাদি ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে, (বিভিন্ন দলের) মধ্যে হয়নি। Within হয়েছে, Not Between।
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি ও তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের বাকি চার নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিদায়ী সিইসি বলেন, সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনে এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা হয়েছে, দলের মধ্যে নয়। একদলীয় নির্বাচন হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। ভোটের পর বিজয়ী পেয়েছি, কিন্তু বহুদলের মধ্যে ভোট হয়নি।
আরও পড়ুন- প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ৪ কমিশনারের পদত্যাগ
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধ দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।
লিখিত ববক্তব্যে সিইসি বলেন, দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ (তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়) সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সূক্ষ্ণ বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭টি ও আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বিষয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। এটা নিয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সিইসি বলেন, নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে, তাও সংবিধানে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেনি। নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়-দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশীশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সকল নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচনগুলো সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। কমিশনের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুবছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি ও সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ-হওয়া নিয়ে অতীতের মতো ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সে কারণে নির্বাচন হয়নি, এমন উদাহরণ নেই। সরকার বারবার বলছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এ কথাটির মধ্যেই নিহিত।
এ দিন দুপুর ১২টার দিকে আনুষ্ঠানিক এই সংবাদ সম্মেলন করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। এর আগে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ইসি সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে সিইসিসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য জমা দিয়েছেন।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
ইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংবাদ সম্মেলন সিইসি