১৫ বছরে ৪০ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স, তালিকায় উজি পিস্তলও
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৫৫
ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র রয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। তবে এর বাইরেও রয়েছে ব্যক্তি মালিকানায় লাইসেন্স দেওয়া অস্ত্র। শুধু তাই নয়, এসব অস্ত্রের অংশের অস্ত্র রীতিমতো অবৈধ।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জনের প্রাণাহানি হয়। এরপর ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত সাড়ে ছয় শ প্রাণহানির তথ্য এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন দায়িত্ব নিয়েই ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের টানা চার মেয়াদে দেওয়া বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে।
সরকারের পক্ষ থেকে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ধরনের অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহর থেকে অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরুও হয়েছে এরই মধ্যে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে যেব অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তার অর্ধেকই জমা পড়েনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এমনকি অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেছেন— এমন সংখ্যাও কম নয়। এর মধ্যে বিশেষ ধরনের অস্ত্র উজি পিস্তলধারীর সংখ্যা ১০ জনের বেশি।
পুলিশ বলছে, উজি পিস্তল বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও নেই। এই অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার সরকারের নেই। এরপরও নিয়ম ভেঙে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তার নেতাকর্মীদের উজি পিস্তলের লাইসেন্স দিয়েছেন। হাতিরঝিলের এক নেতাও উজি পিস্তলের লাইসেন্স নিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কারণেই। এ ছাড়া ধানমন্ডি, মিরপুর-১, পল্লবী, লালবাগ, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, মহাখালী ও শাহজাদপুরের বেশ কয়েকজন নেতা উজি পিস্তলের লাইলেন্স পেয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র বলছে, মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহমুদ শরীফ অপু ও ব্যক্তিগত সহকারী মনির হোসেন উজি পিস্তলের লাইসেন্সের চূড়ান্ত আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে নিতেন। এই উজি পিস্তলধারীদের কেউই এখনো থানায় যোগাযোগ করেননি। পুলিশের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উজি পিস্তলের লাইসেন্স যাদের ছিল, তারা সবাই এখন পলাতক।
এদিকে উজি পিস্তলের বাইরে গত ১৬ বছরে অন্তত ৪০ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এ সংক্রান্ত কোনো সঠিক তথ্য পুলিশ সদর দফতর কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, আট হাজার অস্ত্রের লাইসেন্সের হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। এসব অস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিজেদের মতো ব্যবহার করতেন। নিজেরাই গুলি কিনতেন। থানার পক্ষ থেকে জবাবদিহিতার কথা বলা হলে বড় নেতাদের ভয় দেখিয়ে কিংবা ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ফোন দিয়ে সবকিছু থামিয়ে রাখা হতো।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, এখন আওয়ামী লীগ সরকার নেই। নেতাকর্মীরাও পলাতক। ওইসব ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাও নেই। অস্ত্রও জমা পড়েনি। পুলিশ এখন কী করবে? অভিযান ছাড়া উপায় নেই। এসব অস্ত্র উদ্ধার করতেই হবে। অস্ত্র জমা না দেওয়া বা উদ্ধার করা না গেলে আলটিমেটলি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসব বিষয়ে জানতে পুলিশ অধিদফতরের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দ্বারস্থ হলে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত অধিদফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহসান মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে জেনে জানাতে হবে।’ পরদিন বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) তিনি ফোন করে একটি তালিকা পাঠান। ওই তালিকায় লাইসেন্সধারী অস্ত্রের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। বরং ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর যেসব অস্ত্র খোয়া গেছে, সেগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
উজি পিস্তলের বিষয়ে কামরুল আহসান কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তার দেওয়া তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন অস্ত্রের মধ্যে পাঁচ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি দুই হাজার ৬৬টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। অন্যদিকে গুলি লুট করা হয়েছে ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২টি। এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২টি। বাকি তিন লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি গুলি উদ্ধার করা যায়নি।
এ ছাড়া লুট হওয়া ৩১ হাজার ৪৪টি টিয়ার শেলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ২২ হাজার ১৩৯টি, বাকি আট হাজার ৯০৫টি উদ্ধার হয়নি। গ্যাস গ্রেনেড লুট হয়েছিল এক হাজার ৪৫৫টি, উদ্ধার হয়েছে ৭০৪টি। সাউন্ড গ্রেনেড চার হাজার ৬৯২টির মধ্যে দুই হাজার ১১৬টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ২৯১টির মধ্যে ২১৩টি, সেভেন/মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৫৫টির মধ্যে ১৮টি, ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ ব্যাং গ্রেনেড ৮৯৩টির মধ্যে ৫৩৩টি এবং হ্যান্ড-হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে (ক্যানিস্টার) ১৭৭টির মধ্যে ৯৪টি উদ্ধার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ছোট-বড় অস্ত্র মিলিয়ে মোট ৪০ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। এর মধ্যে অনেকে অস্ত্র জমা দিয়ে লাইসেন্স বাতিল করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এরপরও অস্ত্রের লাইসেন্স কমবেশি ৪০ হাজারের কাছাকাছি রয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এখনো যারা অস্ত্র জমা দেননি, তাদের অস্ত্র অবৈধ হয়ে গেছে। এখন অভিযান চালিয়ে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা চলবে। পাশাপাশি যাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র ছিল, যেগুলো দিয়ে আমরা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়তে দেখেছি, সেগুলোও উদ্ধার করা হবে।
উজি পিস্তলের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের কাজে লাগাতেই এসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এটি কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এর আগে আর কোনো সরকারের সময় এভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।
নিরাপত্ত বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এসব ভয়ংকর অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে সরকার দেশের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। এখন এসব অস্ত্র যত দ্রুতসম্ভব উদ্ধার করতে হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন কেউ এ ধরনের অস্ত্রের লাইসেন্স দিতে না পারে, সেজন্য কঠোর আইন করে যেতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, বছরে দুই লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে কর প্রদান করেন, এলাকায় সম্মানিত, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে, প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে— এমন ব্যক্তিরাই কেবল অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের জন্য উপযুক্ত। থানা পুলিশ, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসআইয়ের প্রতিবেদন পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক সেই আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই আবেদন যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স ইস্যু করে থাকে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আবেদন করলেই অস্ত্রের লাইসেন্স দিতে হবে, এমন কোনো বিষয় নেই। অনেক আবেদন পুলিশ-ডিবি-এসবির প্রতিবেদনে বাতিল হয়ে যেতে পারে। মন্ত্রণালয়ও চাইলে লাইসেন্স না-ও দিতে পারে। কিন্তু গত ১৬ বছরে দলীয় নেতাকর্মীদের বেশির ভাগ আবেদনের বিপরীতে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এমনকি বছরে ৫০ হাজার টাকাও কর দেননি— এমন ব্যক্তিও অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। এ সংখ্যা হাজারেরও বেশি।
এ বিষয়ে জানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলেও কোনো কর্মকর্তা স্বনামে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
অস্ত্রের লাইসেন্স আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উজি পিস্তল পুলিশ বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়