মানিকগঞ্জের পরিবহন সেক্টরে নেই চাঁদাবাজি, স্বস্তিতে মালিক-শ্রমিকরা
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫০
মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জে গণপরিবহন সেক্টরে আওয়ামী লীগের আমলে গেল ১৬ বছরে চাঁদাবাজি ছিল ওপেন সিক্রেট। মাসে কোটি টাকার ওপরে এই সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি চলতো আওয়ামী লীগ ও পরিবহন-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমিতির নামে।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আস্থাভাজন জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বেই মূলত চলতো এই চাঁদাবাজির মহোৎসব। তিনি মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি মানিকগঞ্জ বাস মালিক সমিতির সভাপতি। মূলত তার নেতৃত্বেই সকাল থেকে রাত অবধি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলরত হাজারো গণপরিবহন থেকে বছরে ১৫ কোটি টাকার মোটা অংকের চাঁদা তোলা হতো। আর এই চাঁদাবাজির টাকার বড় একটি অংশ যেত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পকেটে।
তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই চাঁদাবাজরাও যে যার মতো আত্মগোপনে চলে গেছে। তাছাড়া জেলায় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা। ফলে গণপরিবহনের মালিক শ্রমিকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। মানিকগঞ্জের পরিবহন সেক্টর এখন পুরোপুরি চাঁদাবাজ মুক্ত।
সরজমিন ঢাকা আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল মালিক শ্রমিকদের মধ্যে উৎফুল্লতা। চাঁদা দেয়া নেয়ার কোনো বালাই নেই৷ নির্বিঘ্নে টার্মিনাল থেকে যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন ছেড়ে যাচ্ছে আবার ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসছে। নিয়ম শৃঙ্খলাও রয়েছে পরিপাটি।
স্বস্তি ফিরে এসেছে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের মধ্যে। প্রায় একমাস ধরে শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতার নির্দেশে পরিবহন সেক্টরে স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বেচ্ছায় কাজ করে যাচ্ছেন। ৩০ থেকে ৩৫ জন শৃঙ্খলায় কাজ করছে বলে জানিয়েছেন জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক লিটন।
পরিবহন মালিকেরা জানিয়েছেন, গেল প্রায় ১৬ বছরে মানিকগঞ্জে পরিবহন সেক্টরে ছিল চাঁদাবাজির মহোৎসব। আওয়ামী লীগ ও পরিবহন-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমিতির নামে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিশ্বস্ত জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে গণপরিবহন থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে আসছিল। এক ধরনের জিম্মি করেই গণপরিবহনের মালিক শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতিমানে কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিত। পরিবহন সেক্টরের মালিক শ্রমিকদের তথ্য অনুযায়ী বছরে কম করে হলেও ১৫ কোটি টাকার উপরে চাঁদা তোলা হতো।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই টাকার বড় একটি অংশ যেত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পকেটে। তাছাড়া বাকি টাকা প্রতিমাসে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট লোকজনদের মাঝে কিছু কিছু দেয়া হলেও সিংহ ভাগ থাকতো জাহিদের পকেটে। পরিবহন মালিকেরা চাঁদা দিতে না চাইলে তাদের ওপর নির্যাতন চালাত বলেও অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি চাঁদার টাকা যেতো পুলিশের পকেটেও।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলরত গণপরিবহনের মধ্যে সেলফি, নিলাচল, শুভযাত্রা যাত্রীসেবা, ম্যাক্সি,হাইওয়েমিনিবাস,হায়েচ,প্রাইভেটকার,সিএনজি ও হ্যালোবাইকসহ বিভিস্ন গণপরিবহন থেকেই মূলত চাঁদা তোলা হতো।
তথ্যমতে,মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে ৭০- ৮০টি শুভযাত্রা ঢাকায় যাতায়াত করে থাকে। প্রতি গাড়ি থেকে শুধুমাত্র মানিকগঞ্জেই চাদা গুনতে হতো ১৩০০শ টাকা। সেলফি পরিবহনের ১৫০টির উপরে বাস পাটুরিয়া থেকে গাবতলি যাওয়া আসা করেত মানিকগঞ্জে প্রতি গাড়ি বাবদ চাদা দিতে হতো ৩৮০ টাকা করে। ১২০টি নিলাচল চলাচল করতে প্রতি গাড়িতে গুনতে হতো ১৭০ টাকা। হাইওয়েমিনিবাস চলাচল করে ১২০টির উপরে। প্রতি গাড়ি থেকে চাদা নেয়া হতো ২৭০ টাকা করে। বানিয়াজুরী টু মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৬০-৭০টি ম্যাক্সি চলাচল করলেও প্রতি গাড়ি থেকে চাদা নেয়া হতো ৩০০শ টাকা। তাছাড়া প্রতি গাড়ি থেকে পুলিশকে মাসে দেয়া হতো আরো ২ হাজার টাকা করে।
আরিচা-পাটুরিয়া থেকে যাত্রীসেবা চলাচল করে ৭০টির উপরে। প্রতি গাড়ি থেকে চাদা দিতে হতো ১৭০ টাকা করে। রেন্টিকারে ভাড়ায় চালিত প্রতিটি হায়েচ মাসে ১৭০০ এবং প্রাইভেটকারকে চাঁদা দিতে হতো মাসে ৬০০ টাকা করে। এছাড়া ৬০ থেকে ৭০টি সিএনজির প্রতিটি থেকে চাঁদা আদায় করা হতো ১০০ টাকা করে। তিন শতাধিক হ্যালোবাইক জেলা শহর ও তার আশপাশে চলাচল করতে প্রতিটি থেকে ৩০ টাকার উপরে চাঁদা তোলা হতো।
চাঁদাবাজির মূলহোতা বাস মালিক সমিতির সভাপতি ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান। তার হাতিয়ার হিসেবে ছিল তারই ছোট ভাই মাহিদুর ইসলাম, নারী চাঁদাবাজ মায়া খানসহ আরো কয়েকজন। তাছাড়া চাঁদাবাজির আরেক নেতা হচ্ছেন জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকার।
পরিবহন সেক্টরে জাহিদের উত্থানের আগে তার নিয়ন্ত্রণে ছিল এই খাতটি। সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রীর একসময়ের আস্থাভাজন বাবুলকে ফেলে জাহিদকে নিজের খলিফা হিসেবে তৈরি করায় পরিবহন সেক্টর জাহিদের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। বেপরোয়া চাদাবাজিতে পরিবহন মালিকেরা চরমভাবে ক্ষুদ্ধ থাকলেও তা প্রকাশ করতে পারতো না। নিরবে তারা সব কিছু হজম করতো বলে জানান।
কথা হয় কয়েকজন পরিবহন মালিকের সঙ্গে। তাদের একজন মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার মানরা এলাকার বাস মালিক মো. সিদ্দিক মিয়া। তিনি বলেন,আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমরা বাস মালিকরা জিম্মি ছিলাম। বাস মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ইচ্ছেমতো আমাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হতো। ক্ষুব্ধ হতাম কিন্তু প্রকাশ করতে পারতাম না। কারণ তাদের ক্ষমতার দাপটের কাছে আমরা পরিবহন মালিকেরা জিম্মি ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের পতনের তিন দিন আগেও মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতে মোট চাঁদা লাগতো ২৭০০ টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র মানিকগঞ্জে নেয়া হতো ১৩০০ টাকা। আর বাকিটা নিতে ঢাকার চাঁদাবাজরা। টাকা না দিলে গাড়ির সিট পর্যন্ত খুলে রাখা হতো। এমনকি গাড়ির তেল বিক্রি করে চাদার টাকা দিতে বাধ্য করতো।
মো. সিদ্দিক মিয়া বলেন,জাহিদের মূল শক্তি ছিল সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। পাশাপাশি পথে-ঘাটে পুলিশকে কম করে হলেও প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে দিতে হতো। ১৫ বছরে গাড়ি ব্যবসায় লাভবান তো দূরের কথা দুবেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই দায় ছিল।
তিনি বলেন, ২০০২ সালে গাড়ি কেনার পর প্রতিদিন ভালই লাভ হতো। লাভের টাকা দিয়ে আরো দুটি গাড়ি কিনেছিলাম। কিন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চাঁদা গুণতে গুণতে জীবন শেষ। পরিবহন সেক্টরে এতো নিষ্ঠুরতা বিগত দিনে দেখিনি। যা আওয়ামী লীগ দেখিয়ে গেছে। তারা ক্ষমতায় থেকে বিদায় নেয়ার পর মানিকগঞ্জে আমার মতো শতশত পরিবহন মালিকেরা স্বস্তিবোধ করছে।
তিনি আরও বলেন,গত প্রায় এক মাস ধরে রাস্তায় কোনো চাঁদাবাজদের টাকা দিতে হচ্ছে না। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতার কঠোর হুঁশিয়ারিতে সমস্ত চাঁদা বন্ধ হয়ে গেছে। বরং শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরা পরিবহন সেক্টরে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বেচ্ছায় শ্রম দিচ্ছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে আমরা ভাল থাকবো।
লেগুনা চালক আমজাদ হোসেন বলেন, বানিয়াজুরী থেকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রতিদিন আমাদের গাড়ি চলাচল করে ৬০ থেকে ৭০টি। এক মাস আগেও মানিকগঞ্জ বাস মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলামের ছোট ভাই মাহিদ ও মায়া খানের নেতৃত্বে আমাদেরকে প্রতি গাড়ি থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নিতো। তাছাড়া প্রতিমাসে পুলিশকে দেয়া হতো ২ হাজার টাকা। সারাদিন মাথার ঘাম ঝরিয়ে যা আয় হতো তার প্রায় অর্ধেক চলে যেতে চাঁদার খাতায়। গত ৫ আগস্টের পর থেকে কোন চাঁদা নেয়া হচ্ছে না। যার ফলে রাস্তায় গাড়িও বেড়ে গেছে। আগে চাঁদার ভয়ে অনেকে রাস্তায় গাড়ি নামাতো না। চাঁদা মুক্ত থাকলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে দুবেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারবো।
মো. বদর উদ্দিন বলেন, রুটে আমার মোট সাতটি ম্যাক্সি ছিল। চাঁদাবাজদের তাণ্ডবে পাঁচটি বিক্রি করে দিয়েছি। কারণ এত টাকা চাঁদা দিয়ে রোডে গাড়ি চালানো সম্ভব নয। জাহিদ, মাহিদ ও মায়া খানের তান্ডবে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। তাদের সাথে ছিল মন্ত্রীর খুঁটার জোর। তারা আমাদের ভালো থাকতে দেয়নি। প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে হলেও প্রতি গাড়ি থেকে মাসে ৯০০০ টাকা শুধুমাত্র তাদের দেয়া হতো। এরপর পুলিশকেও মাসোহারা দেয়া হতো। যার কারণে পাঁচটি গাড়ি বেচে দিতে বাধ্য হয়েছি। তবে গেল এক মাস ধরে আমরা এক রকম শান্তিতে গাড়ি চালাচ্ছি। কোথাও কোন চাঁদা দিতে হচ্ছে না।
এসব বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা বলেন, শুধু গণপরিবহনেই নয়, মানিকগঞ্জের কোথাও কোনো ধরণের চাঁদাবাজি করতে দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, চাদাবাজি বন্ধে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। দলের কোনো নেতাকর্মী যদি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকে তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না। প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি দল থেকে সোজা বহিষ্কার করা হবে।
আফরোজা খান রিতা আরও বলেন, মানিকগঞ্জ হবে শান্তির মডেল। মানুষজন যাতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন সেই অবস্থা তৈরি করতে হবে।
সারাবাংলা/এনইউ