সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চলছে ‘হরিলুটে’র কারবার!
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:০৩
সুনামগঞ্জ: কেনাকাটার অবিশ্বাস্য ব্যয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে চলেছে হরিলুটের কারবার। ভুয়া ভাউচার দিয়ে একবছরে হাসপাতাল থেকে লোপাট হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হাসপাতালের স্টোরকিপার সুলেমান আহমদ, হিসাবরক্ষক মো. ছমিরুল ইসলাম ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. আনিসুর রহমান। এদেরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নিকট স্মারকলিপি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী ইমন দোজা বলেন, ‘সদর হাসপাতালের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। এমন ভয়াবহ দুর্নীতি জানা ছিল না। অডিট প্রতিবেদন থেকে বিষয়টি জানতে পারি। পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উপদেষ্টাদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি আমরা।’
আরেক শিক্ষার্থী উসমান গনি বলেন, ‘জেনেছি এই দুর্নীতিবাজদের খবর একাধিকবার জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এরপরও কিভাবে একই পদে বহাল থাকে তারা সেটি আশ্চর্যের। এরকম চলতে থাকলে সুনামগঞ্জের মানুষ কখনো সুচিকিৎসা পাবে না।’
হাসপাতালের অডিট থেকে জানা যায়, এই হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য পদের ২৫১ জন স্টাফ থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাবার স্ট্যাম্প তৈরি হয়েছে ৩৭২০টি। প্রতিটি স্ট্যাম্পের মূল্য ধরা হয়েছে ৩০৯ টাকা।
এমন অস্বাভাবিক খরচের বিষয়ে নিরীক্ষক দল মন্তব্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, এ-৪ কাগজে কাঁচা ভাউচার তৈরি করে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন হয়েছে। এতো সংখ্যক স্ট্যাম্প বানানো হলেও বাস্তব যাচাইয়ে অধিকাংশই পাওয়া যায়নি।
নার্সরাও নিরীক্ষা দলকে জানিয়েছেন, অফিস থেকে তাদের কোন সিল দেওয়া হয়নি। তাদের ব্যবহৃত সিল তারা নিজেরাই টাকা খরচ করে বানিয়েছেন।
নিরীক্ষা দল ২০২২-২৩ ইংরেজির নিরীক্ষা করলেও তারা পরের অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য স্ট্যাম্প ও সিল কোডে ১২ লাখ ৪২ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২৩ মার্চ ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত ১০ লাখ টাকা সিল বানানো বাবদ উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছেন। নিরীক্ষা কমিটির মন্তব্যে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্ট্যাম্পের বরাদ্দ যথাযথ নিয়মে উত্তোলন হয়নি।
এছাড়া নিরীক্ষা কমিটির মন্তব্যে বলা হয়েছে, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে সিল তৈরির খরচ দেখানো হয়েছে। ভাউচারগুলো এসব প্রতিষ্ঠানের নয়। অডিট কমিটি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এই টাকা আদায়পূর্বক দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন।
সিল তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে শহরের পৌর বিপণি’র পিনাক আর্ট ও শফিক আর্টের ভাউচার দেখানো হলেও এই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকই বলেছেন, তাদের কাছ থেকে চার-পাঁচ হাজার টাকার বেশি সিল নেওয়া হয়নি। এই ভাউচারও তাদের নয়। একটি সিলের সবোর্চ্চ মূল্য ৪০-৫০ টাকার চেয়ে বেশি নয়।
এছাড়া নির্দেশনা অমান্য করে ওষুধসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার নামে এক বছরে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা’র ক্ষতি করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া হাসপাতালের জন্য লিলেন সামগ্রী যেমন কম্বল, বালিশ, বালিশ কাভার, বিছানার চাদর, রাবার ক্লথ, রেক্সিন ও মশারি ক্রয় করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফরচুন কর্পোরশেন’কে ষোল লাখ ৮৩ হাজার পাঁচ’শ টাকার বেশি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাইরে অর্থাৎ ইডিসিএল থেকে না কিনে বিভিন্ন সরবরাহকারীর কাছ থেকে এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩ টাকার ওষুধ কেনা হয়েছে দেখিয়ে বিল উত্তোলন হলেও এ বিষয়ে কোন প্রমাণ পায়নি নিরীক্ষা কমিটি।
অন্যদিকে আসবাবপত্র ও অফিস সরঞ্জাম সরবরাহ না করলেও মেসার্স সামিয়া এন্টারপ্রাইজ ও আরকে ট্রেডিং নামের দু’টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ২৯ হাজার ৭৫০ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে নিরীক্ষা দল উল্লেখ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এবং ব্যয় মঞ্জুরি গ্রহণ না করে পূর্বের বকেয়া দেখিয়ে ৯৭ লাখ ৭১ হাজার ১২৭ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে বলে নিরীক্ষা দল উল্লেখ করেছে। স্টোর থেকে লিলেন সামগ্রী বিতরণের প্রমাণও নেই।
এসব বিষয়ে অভিযুক্ত সুলেমান মিয়া বলেন, ‘অডিট আপত্তি সব অফিসেই আছে। অডিট আপত্তিতে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে কার্যকর নয়। এগুলোরও আপত্তি দেওয়া হয়েছে। নথিপত্র যাচাই করে ব্রডশিটে এসবের জবাব দেব আমরা। এখানে কোন অনিয়ম হয়নি।’
হিসাব রক্ষক ছমিরুল বলেন, ‘আমি কর্মচারী মাত্র। অবৈধভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই। যা আদেশ দেওয়া হয় তা পালন করি।’
হাসপাতালের তৎকালীন উপপরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান অডিট প্রতিবেদনের বিষয়ে বলেন, ‘আমি যা করেছি রোগীদের স্বার্থে করেছি। অডিট আপত্তি হতেই পারে। আমরা প্রতিটি আপত্তির জবাব দেব। তবে অডিট আপিত্তর জবাবই গেল না এর আগেই এটা বাইরে কীভাবে গেল এটি জানতে চাইবো আমি। আমার মনে হয়েছে কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে বিতর্কিত করতে চাইছে।’
হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সুলেমান ও ছমিরুলই এখন হাসপাতালের বড় সমস্যা। মূলত এরাই সব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। আমাকেও তারা নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দিচ্ছে। আমি প্রশাসন ও পুলিশকে সব অবহিত করেছি।’
সারাবাংলা/এমও