Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভুয়া বিল ভাউচারে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে অর্থ লোপাট

আল হাবিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০১:২৮

সুনামগঞ্জ: জেলার ২৬ লাখ মানুষের নির্ভরতার জায়গা হওয়ার কথা ছিল সুনামগঞ্জ ২৫০ শষ্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল। সে আশা পূরণতো দূরে থাক, উল্টো হাসপাতালটিতে অনেক বছর ধরেই চলছে লুটপাটের মহোৎসব। এখানে এক বছরে যে লুটপাট হয়েছে-তা জানলে যে কারো চোখ কপালে উঠতে বাধ্য।

অডিট রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ২০২২-২৩ বছরে কেবল সেমিনারের আপ্যায়ন দেখিয়ে ১২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা এবং সভা-উৎসবের নামে সাড়ে ২৪ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সেমিনারের নামে আপ্যায়ন দেখিয়ে ১২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা খরচের বিষয়ে নিরীক্ষক দল মন্তব্যে লিখেছেন, কী বিষয়ে সভা করা হয়েছে, কিংবা সভা আহ্বানের পূর্বে অফিস আদেশ জারি এবং সভায় কতজন কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেছেন এমন নামের তালিকা পাওয়া যায়নি। যে সব প্রতিষ্ঠানের নামে ভাউচার তৈরি করা হয়েছে, সেসব ভাউচারে ক্যাশ মেমো নম্বরও পাওয়া যায়নি।

ভাউচারগুলো হাসপাতাল কর্তৃক কম্পিউটার প্রিন্ট করে তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে সেমিনারের আয়োজন না করে কেবল বরাদ্দকৃত অর্থের লুটপাট জায়েজ করার উদ্দেশ্যে বিল ভাউচার তৈরি করা হয়েছে।

হাসপাতালের হেলথ এডুকেটর নয়ন দাস ও স্টোর কিপার সুলেমান আহমদ কর্তৃক তৈরি করা বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠান ও উৎসবাদির নামে কাচা ভাউচারমূলে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। এই খরচের মধ্যে ব্যানার-ফেস্টুনের জন্য ১৭ লাখ ২৫ হাজার এবং আপ্যায়নের উসিলায় ৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার ভাউচার হয়েছে।

নিরীক্ষক দল মন্তব্যে লিখেছেন, যে সব প্রতিষ্ঠানের নামে কাচা ভাউচার তৈরি করা হয়েছে- ভাউচারগুলো এসব প্রতিষ্ঠানের নয়। ভাউচারে ক্যাশ মেমো নম্বরও নেই। ভাউচারগুলো হাসপাতালের কম্পিউটার দ্বারা প্রিন্ট করা। সভা অনুষ্ঠানের কোনো অফিস আদেশ নেই। এ সংক্রান্ত কোনো ব্যানারও নেই।

বিজ্ঞাপন

এমএসআর সামগ্রী ক্রয়ের নামে টাকা নয়-ছয়:

ডায়ালাইসিস ওয়ার্ডে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ক্রয়কৃত ফোলি ক্যাথেটার ৪৫ পিস এবং জে.ক্যাথেটার ১৯ পিস, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ক্রয়কৃত ফোলি ক্যাথেটার ৭৫ পিস এবং জে.ক্যাথেটার ​​​​​​​৯০ পিস, ডায়ালাইসিস ওয়ার্ডের স্টোরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে এবং এগুলোর মেয়াদও অল্প দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

এছাড়া হাসপাতালটি ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হবার পর এসব পণ্য ব্যবহার করার জন্য কোনো কিডনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও হাসপাতালে নেই। এরপরও এসব পণ্য ক্রয় দেখিয়ে ১৪ লাখ ১২ হাজার ২৫০ টাকা উত্তোলন হয়েছে।

ভাউচার ব্যবহার না করে জালিয়াতি:

নিরীক্ষক দল যাচাইকালে দেখতে পান, পণ্য সরবরাহকারীর ভাউচার ব্যবহার না করে বিল পরিশোধ করার নামে সরকারের ৪২ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা লুটপাট হয়েছে। যেমন-পলিথিন ব্যাগ, পুরস্কারের ক্রেস্ট, মুদ্রণ সামগ্রী, পাপোস গ্রহণের ক্ষেত্রে সরবরাহকারীর লোগো এবং নম্বর সম্বলিত ভাউচার ব্যবহার করা হয়নি। হাসপাতালে তৈরি ভাউচারে বিল উত্তোলন হয়েছে। পণ্য গ্রহণ ও বিতরণের কোনো রেজিস্টার ব্যবহার করা হয়নি। পণ্যগুলোর গ্রহণ এবং বিতরণের কোনো প্রমাণও নেই।

অনিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি ৮১ লাখ ৭০ হাজার টাকা:

হাসপাতালে আউটসোর্সিং জনবল থাকা সত্ত্বেও অনিয়মিত শ্রমিকদের মজুরি বিল পরিশোধের নামে ৮১ লাখ ৭০ হাজার টাকা লুটপাট হয়েছে। মজুরির বিলে শুক্রবার দিনটিও (ছুটির দিন) যুক্ত করা হয়েছে। নিরীক্ষক দল এসব শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে, তারা নিজেদের ‘স্বেচ্ছাসেবক’ হিসেবে পরিচয় দেন। হাসপাতালের স্টোর কিপার সুলেমান আহমদ ও হিসাবরক্ষক ছমিরুল তাদেরকে নামমাত্র বেতন দিয়ে, বাকি টাকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রেখে দেন বলে স্বীকার করেছেন। এই খরচের জন্য মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন নেই বলে নিরীক্ষক দল মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন। এরকম নিজেদের বানানো বিল ভাউচারে এবং নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য সুলেমান ও ছমিরুলকে হাসপাতাল থেকে অব্যাহতি দিলেও তা বাতিল করা হয়। এসব অনিয়মের অন্যতম সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান। তার বদলির আদেশের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে যায় জেলা আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি চিঠি। জামায়াত শিবিরের তকমা দিয়ে বদলির অনুরোধ পাঠান নোমান বখত পলিন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান উল্লেখ করে বহাল রাখার অনুরোধ করেন নুরুল হুদা মুকুট।

১৯ আগস্ট থেকে অযৌক্তক দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নামে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। যার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্র্মীরা। পৃথক দিনে হামলা চালানো হয় তত্ত্বাবধায়কের বাসভবনে ও হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ে। যার নেপথ্যে সুলেমান সিন্ডিকেট কাজ করেছে বলে অভিযোগ তত্ত্বাবধায়কের। নাম উল্লেখ করে করেছেন থানায় জিডি।

আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে হাসপাতালে অরাজকতা সৃষ্টি করাতে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ এসে নিজ আত্মীয় এলাকা থেকে গাড়ি ভর্তি করে মানুষ পাঠানোর অভিযোগও করেছেন অনেকে। ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতাও পাওয়া গেছে।

হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে স্টোর কিপার সুলেমান আহমেদ বলেন, কোনো বিবেকবান মানুষ স্যারের ওপর হামলা চালাবে না। আমার পক্ষেও তা অসম্ভব। স্যারেরা বদলি করেন, আবার তারাই বহাল করেন বিধায় থাকতে পারি। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।

একই কথা বলেন অভিযুক্ত হিসাবরক্ষক ছমিরুল।

দায়িত্বে থাকাকলীন কোনো অনিয়ম হয়নি দাবি করে তৎকালীন উপ-পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, বিধি বহির্র্ভূতভাবে হাসপাতালের দুইজন কর্মচারীকে বদলি করা হয়। তাই তাদের বদলি আদেশ বাতিল করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, অডিট আপত্তিকে অভিযোগ হিসেবে উল্লেখ করলে ভুল হবে এবং যারাই এটা প্রচার করছে তারাও কিন্তু ক্রাইম (অপরাধ) করছে। কারণ আমরা অডিট আপত্তি’র জবাব এখনো দেইনি। যারা এটি অফিসের নিয়ম কানুন ভেঙে বাইরে দিয়েছে, তারা অন্যায় করেছে।

সারাবাংলা/এনইউ

অডিট রিপোর্ট কোটি টাকা বিল ভাউচার ভুয়া লোপাট সুনামগঞ্জ ২৫০ শষ্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর