Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোনো পুলিশ রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করবে না— সারাবাংলাকে সিএমপি কমিশনার

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) গঠনের পর তৃতীয় কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এম আজিজুল হক, যিনি পরবর্তী সময়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হয়েছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্রান্তিকালে সিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন তারই সন্তান হাসিব আজিজ। এ রকম দায়িত্বশীল চেয়ারে পিতার পর সন্তান— এমন ঘটনা বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে এই প্রথম।

বিজ্ঞাপন

ক্রান্তিকালে সিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ, নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার, ইউনিট নিয়ে স্বপ্ন-সম্ভাবনা— নানা বিষয়ে সারাবাংলার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন হাসিব আজিজ। অকপটে বলিষ্ঠ উচ্চারণে তুলে ধরেছেন নিজের মতামত। বুধবার (১১ জুলাই) বিকেলে নগরীর দামপাড়ায় সিএমপি কার্যালয়ে কমিশনার তিনি মুখোমুখি হন সারাবাংলার।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পর গত ৫ সেপ্টেম্বর সিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া হাসিব আজিজ বলছেন, সিএমপির কোনো পুলিশ সদস্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা কোটারি স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে না। কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং, হ্যালো সিএমপিসহ জনকল্যাণমুখী নানা পদক্ষেপ চালু করে সিএমপিকে গণমানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়াই হবে তার লক্ষ্য।

‘ক্রান্তিকালের দায়িত্বকে সুযোগ হিসেবে দেখছি’

প্রায় ২৯ বছরের চাকরিজীবন হাসিব আজিজের। সিএমপি কমিশনারের ‘অনার বোর্ডে’র তিন নম্বরে পিতা এবং ৩৩ নম্বরে লেখা হয়েছে ছেলে হাসিব আজিজের নাম। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমত, আল্লাহর রহমত, আল্লাহর রহমত। এটা বিরল সৌভাগ্যের বিষয়।’

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে সিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে হাসিব আজিজ বলেন, ‘কোনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি না। বরং সুবর্ণ সুযোগ (গোল্ডেন অপরচুনিটি) হিসেবে দেখছি। একটা অস্থির সময়ে, পুলিশের একটা ইউনিট, যার প্রায় সবগুলো থানা আক্রান্ত হয়েছে, ছয়টা থানা পুড়েছে, সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রক্রিয়াটা, তার একজন অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত।’

বিজ্ঞাপন

‘এটিকে আমি একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি। ক্রান্তিকালে একটা সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগটা আমি ইনশল্লাহ সদ্ব্যবহার করব।’

বাবা এম আজিজুল হক ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার। ৩৩ বছর পর একই চেয়ারে বসেছেন ছেলে হাসিব আজিজ। ছবি: সারাবাংলা

‘পুলিশের রাজনীতিকরণ হারাম’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একদম শেষ ধাপে শেখ হাসিনা সরকার পতনের সময় সিএমপির ছয়টি থানায় অগ্নিসংযোগসহ প্রায় সব থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। সিএমপি কমিশনার নিজেই বলছেন, পুলিশ সাধারণ জনগণের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু কেন পুলিশই ছিল লক্ষ্য— এ প্রসঙ্গে নিজের মতামত তুলে ধরে হাসিব আজিজ বলেন, ‘যারা লোয়ার র‌্যাংকের সহকর্মী আছেন, তাদের অভিযোগের মধ্যে একটা ছিল যে এতদিন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। যারা সিনিয়র কমান্ডিং অফিসার ছিলেন, তারা রাজনৈতিক নেতাদের কথায় লোয়ার র‌্যাংকের অফিসারদের কমান্ড করতেন এবং অর্ডার ক্যারি করতে বাধ্য করেছেন। এ জন্য থানা-ফাঁড়িগুলোতে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।’

‘আমরা বলছি— পুলিশের রাজনীতিকরণ হারাম, হারাম, হারাম। এটা নিষিদ্ধ। পুলিশ কোনো অবস্থাতেই কোনো রাজনীতি বা কোনো কোটারি স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে না। আমরা এখন থেকে সমভাবে রাষ্ট্রের সব মানুষের জন্য কাজ করব। আমি সিএমপি কমিশনার হিসেবে বলছি, আমার ইউনিট সব নাগরিকের নিরাপত্তা, সব নাগরিকের শান্তির জন্য কাজ করবে। সিএমপিতে সব সদস্যকে মেসেজ দিয়েছি, দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে হবে।’

হাসিব আজিজ আরও বলেন, ‘পূর্ববাংলার মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় নোবেল লরিয়েট, একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। উনি এবং উনার সরকার বাংলাদেশের মানুষের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ নিয়ামত। উনার নেতৃত্বে আমরা কাজ করছি। আমরা এমনভাবে কাজ করব যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এজেন্ডাটা পূরণে সহায়ক হয়।’

‘আমাদের তরফ থেকে এটা বলতে পারি, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশ জড়াবে না। পুলিশ তার পুলিশিং করবে আইন অনুযায়ী। পুলিশ সবার, সব মানুষের, সব শ্রেণিপেশার, সব ধর্মের। রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য করবে না, আমাদের সংবিধানে বলা আছে। পুলিশ সেই সংবিধান মেনে চলবে,’— বলেন সিএমপি কমিশনার।

চালু হচ্ছে কমিউনিটি পুলিশিং

সিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম নগরীতে কমিউনিটি পুলিশের থানাভিত্তিক ও কেন্দ্রীয় যে কমিটি ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে। নতুনভাবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাগরিকদের নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওপেন হাউজ ডে চালুর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

‘সব শ্রেণিপেশা ও ধর্মের ভিত্তিতে সর্বজনশ্রদ্ধেয় যারা আছেন, যাদের বিরুদ্ধে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই, তাদের নিয়ে কমিটি করা হবে। কারও রাজনৈতিক মতামত থাকতে পারে, কেউ নির্দিষ্ট একটা পার্টি করতে পারে। কিন্তু তার বিরোধী পার্টি যিনি করেন, তার প্রতি যদি কমিউনিটির শ্রদ্ধা থাকে, আপত্তি না থাকে, তাহলে তিনিও থাকবেন কমিটিতে। অর্থাৎ সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষগুলোই থাকবেন।’

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সমন্বয়ক যারা আছেন, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে যেন কমিটিগুলো করা হয়, এটা আমি বলে দিয়েছি,’— বলেন হাসিব আজিজ।

ওপেন হাউজ ডে চালুর বিষয়ে কমিশনার বলেন, ‘অপরাধ বিভাগের চারজন উপকমিশনার (ডিসি) প্রতি রোববার তাদের অফিসে ওপেন হাউজ ডে করবেন। কোনো একজন ব্যক্তি থানায় গিয়ে প্রত্যাশিত সেবা না পেলে তিনি রোববার সরাসরি ডিসি অফিসে গিয়ে সেটি বলতে পারবেন। আর ডিসি অফিসে প্রত্যাশিত সেবা না পেলে কমিশনারের কাছে আসবেন, প্রতি মঙ্গলবার আমি শুনব।’

‘হ্যালো সিএমপি, আইস অব সিএমপি, আমার গাড়ি নিরাপদ— এগুলো সব চালু করা হবে। আগে থেকে চলে আসা যেগুলো ভালো, সেগুলো থাকবে। আর যেগুলো খারাপ, সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দেবো।’

শহরজুড়ে গভীর রাত পর্যন্ত টহলের ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগও দ্রুতই নিতে চান সিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা আছে, অন্তত রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত সম্পূর্ণ শহরকে পুলিশি প্যাট্রলের আওতায় নিয়ে আসব। দুইটা করে হোন্ডা, চারজন করে লোক, একটি করে ওয়াকিটকি, গ্যাসগান-শটগান, একটি এসএমজি, একটি রাইফেল দিয়ে টহল চলবে। একজন এএসআই, সঙ্গে তিনজন কনস্টেবল থাকবে। জনউপদ্রবের বিরুদ্ধে, থানাকে সহযোগিতা করা ও মানুষের প্রয়োজনে দ্রুত রেসপন্স করা হবে তাদের কাজ। কমিউনিটি-বেজড পুলিশিং— এটাই চলবে।’

এ ক্ষেত্রে যানবাহনের সংকট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন সিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, ‘আমাদের ৭৬টা গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ২৮টা পুরোপুরি পুড়ে গেছে। বাকিগুলো রিপেয়ার হচ্ছে। আমরা অলরেডি গাড়ির জন্য হেডকোয়ার্টারে রিকুইজিশন দিয়েছি। তবে ফুট পেট্রল অথবা হোন্ডা পেট্রল— এগুলো শুরু করা হবে।’

রাজনৈতিক উদ্দেশে পুলিশের ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক চিন্তাপ্রসূত পুলিশ আইন সংস্কারের পক্ষেও হাসিব আজিজ সোচ্চার। ছবি: সারাবাংলা

‘ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে প্রণীত আইন পরিবর্তন দরকার’

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার পতনের পর থেকে পুলিশ সদস্যরা নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। তারা তো বটেই, সার্বিকভাবেও পুলিশ আইন সংস্কারের দাবি উঠেছে। সিএমপি কমিশনার নিজেও এই আইন সংস্কারের পক্ষেই মত দিয়েছেন।

হাসিব আজিজ বলেন, ‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৮২৯ সালে পুলিশ অ্যাক্ট করা হয়েছিল। তারা লন্ডনে যে অ্যাক্টটা করেছিল, সেটা ছিল তাদের নিজেদের জন্য, কমিউনিটি-বেজড। আর ভারতের জন্য যেটা করা হয়েছিল, সেটা ছিল দমন-পীড়নমূলক। লোকজন যেন বিদ্রোহ না করে, সবসময় যেন খাজনা দেয়, ঠিক সময়ে না দিলে যেন ধরে জেলে দেওয়া যায়— এগুলোতেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এখন সংস্কারের কথাটা যে উঠছে, সেটার বেসিক পয়েন্ট হচ্ছে ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে প্রণীত পুলিশ অ্যাক্টের পরিবর্তন করা। পুলিশ অ্যাক্ট, পিআরবি, সিআরপিসি, পেনাল কোড— এগুলো সবই কিন্তু ঔপনিবেশিক সময়ের। সংস্কারের দাবিটা এ কারণে উঠছে।’

‘পুলিশ আইন সংস্কারের জন্য বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে ও ২০০৭ সালে দুই দফায় কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের সুপারিশগুলো এখনো ঝুলে আছে, বাস্তবায়ন হয়নি। পুলিশে সংস্কার আমরাও চাই। কিন্তু এটি একটি বিশাল বিষয়। আমি সিএমপি কমিশনার হিসেবে যেটুকু বলতে পারি, আমার প্রায়োরিটি হচ্ছে আমরা সংবিধিবদ্ধ আইনের ভেতরে থেকে সিএমপিতে কমিউনিটি পুলিশিং চালু করব, বিট পুলিশিং চালু করব।’

‘চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অতুলনীয়’

চট্টগ্রামের মানুষের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের প্রশংসা করে সিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমি একটা কথা সব জায়গায় বলি— চট্টগ্রামের মানুষের ভেতরে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সদ্ভাব ও সহাবস্থান— এটা অতুলনীয়। এত চমৎকার সম্পর্ক আমি খুব কম দেখেছি। আমি ২০০২, ২০০৩ ও ২০০৪— এই তিন বছর চট্টগ্রাম জেলার অ্যাডিশনাল এসপি হিসেবে দুর্গা পূজার ডিউটি করেছি। আমি কোথাও একটাও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখিনি।’

‘আমার মেসেজ হচ্ছে— রাষ্ট্র সবার। ধর্মটা ব্যক্তির, কিন্তু রাষ্ট্র সকলের। ঈদ যেভাবে পালন হয়, পূজাও সেভাবে নিরাপত্তার সঙ্গে পালন হবে। যার যার ধর্মবিশ্বাস আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে সে পালন করবে। কিন্তু একজনেরটা আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দিতে গেলে সমস্যা। এটা যেন কেউ কোথাও করতে না পারে, এ জন্য আমরা মোটিভেশন ক্যাম্পেইনটা চালু রেখেছি। আশা করি, সবাই যার যার অবস্থানে থেকে নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব সুন্দরভাবে পালন করবেন,’— বলেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

কমিউনিটি পুলিশিং চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সাবেক আইজিপি এম আজিজুল হক সিএমপি সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর