গ্যাস-জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত, বিদ্যুৎ বিভ্রাট আরও ১ মাস
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:০৬
ঢাকা: দুপুর, সন্ধ্যা বা মাঝরাত- কোনো ঘোষণা ছাড়াই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। একবার গেলে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা, কোথাও কোথাও আবার তিন ঘণ্টা পর ফিরে আসে। এই চিত্র রাজধানী ঢাকার। মফস্বল কিংবা গ্রামাঞ্চলে এলাকা ভেদে আরও বেশি লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রাহকরা বলছেন, তীব্র গরমে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জীবন-যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ সংকটের এই প্রভাব পড়েছে কল-কারখানা এবং সেচ কাজেও। বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে সংকট বর্তমানে তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে এক মাস সময় লাগতে পারে।
খাতা-কলমে বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৩১ হাজার ৫২০ মেগাওয়াট। সেখানে স্বাভাবিক সময়ে উৎপাদন হয় ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। কিন্তু ডলার সংকটে পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। ফলে উৎপাদন নেমেছে ১২ হাজার মেগাওয়াটে। কখনো কখনো এর থেকে বেশি, আবার কমও উৎপাদন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে যে পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার বেশিরভাগই আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট আসে তেল থেকে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখতে বর্তমানে দিনে ১৩০ ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ ঘনফুট গ্যাস।
অন্যদিকে, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সেখানে জ্বালানি সংকটের কারণে সর্বোচ্চ এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে দু’টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আসে। এর মধ্যে সামিটের এলএনজি বন্ধ থাকায় ৬০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটই। ভারতের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে দিনে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। বকেয়া পরিশোধ না করায় সেখান থেকে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
এসব সংকট তৈরি হওয়ায় বুধবারও (১২ সেপ্টেম্বর) দেশে ৩ হাজার মেগাওয়াট লোডশেড করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্র। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে বর্তমানে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু গ্যাস সংকটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেকই অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। বাকি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও চালু রাখা যাচ্ছে না জ্বালানি সংকটের কারণে। এমন পরিস্থিতিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর যে নির্ভর করার কথা তাও করা যাচ্ছে না। কারণ সেখানেও কয়লার সংকট রয়েছে। এমন মুহূর্তে বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, দেশজুড়ে যে লোডশেডিং শুরু হয়েছে তা সহজেই কাটছে না।
এদিকে রাজধানী ঢাকায় কম লোডশেডিং হলেও মফস্বল ও গ্রাম ভেদে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানীর পুরান ঢাকা, মতিঝিল, মানিকনগর, মুগধা, মান্ডা, বাড্ডা, কুড়িল, মিরপুরের কিছু অংশ, শেওড়াপাড়া, মৌচাক, মালিবাগ, নয়াটোলা, পীরেরবাগ এলাকা থেকে লোডশেডিংয়ের খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
মৌচাক এলাকার বাসিন্দা মোহসিন গাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। সবার বাসায় তো জেনারেটর সুবিধা নেই। বাচ্চাদের নিয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছে।’ কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা বৃষ্টি সাহা সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিদ্যুৎ চলে গেলে কমপক্ষে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আসে। এই সময়ে বৃদ্ধা শাশুড়ি আর ছোট ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে।’
আবার অনেক গ্রাহক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, প্রিপেইড মিটারে বিল পরিশোধ করার পরও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। একই অভিযোগ নাজনীন আক্তার নামে একজন লিখেছেন, ‘মাঝরাতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছি লোডশেডিং। এক ঘণ্টা পরে দেখি মিটারে সমস্যা। এর প্রতিকার কী।’
এ প্রসঙ্গে অর্ন্তবর্তকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কারিগরি সমস্যা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ওই ইউনিটের মেরামত চলছে।’ এদিকে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এরই মধ্যে চালু হয়েছে। আদানির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫২টি। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। আমদানি করা হয় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট। মোট গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৭১ লাখ। সুবিধাভোগীর সংখ্যা শতভাগ।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম