বেহাল সড়ক, ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো-সেতু— পদ্মার চরে যাতায়াত মানেই ভোগান্তি
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১৮
মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার দুর্গম চরাঞ্চলে নটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলে যাতায়াতের পথ ভীষণ দুর্গম। রাস্তার অবস্থা বেহাল। সেই ক্ষতবিক্ষত রাস্তা ধরে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের হাঁটতে হয় মাইলের পর মাইল। রাস্তায় নদীও পার হতে হয়। সেই নদী পার হওয়ার উপায় হিসেবে রয়েছে ডিঙি নৌকা কিংবা কাঠ ও বাঁশের জরাজীর্ণ সাঁকো।
পদে পদে এমন ঝুঁকি নিয়েই নটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে যাতায়াত করছে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিথিলা আক্তার কিংবা সপ্তম শ্রেণির ইয়াসিন হোসেন, সোহান মিয়া ও সবুজ কিংবা দশম শ্রেণির খুশি আক্তারসহ বিদ্যালয়টির আট শতাধিক শিক্ষার্থী। কেবল শিক্ষার্থীরা তো নয়, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্যও যাতায়াতের আর কোনো বিকল্প নেই। এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পদ্মার চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে।
স্থানীয়রা বলছেন, হরিরামপুরের চরাঞ্চল মূল উপজেলার ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় প্রশাসনের চোখেরও আড়ালে পড়ে গেছে। সেখানকার মানুষের নিত্যদিনের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ বেহাল যোগাযোগব্যবস্থা। বছর বছর স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধিরা চরাঞ্চলের উন্নয়নের অঙ্গীকার দিয়ে গেলেও বাস্তবে চরাঞ্চলের জীবনমানের খুব একটা উন্নতি হয়নি।
সরেজমিনে প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিয়ে চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা গেছে আঁকাবাঁকা বিধ্বস্ত সড়ক, জরাজীর্ণ বাঁশ-কাঠের সাঁকো আর ডিঙি নৌকায় মানুষ পারাপারের দৃশ্য। বিপর্যস্ত এই যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যেও প্রতিদিন শত শত মানুষের চলাচল থেমে নেই। জীবনের প্রয়োজনে এই প্রতিকূলতার মধ্যেই তাদের পাড়ি দিতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল।
দুর্গম চর লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের পাটগ্রাম এলাকায় খেয়াপাড়া পারে দেখা গেল মানুষজনের দুর্ভোগের চিত্র। ঘাটে ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা। সেটি দিয়েই পারাপার করা করা হচ্ছে মানুষজন। সাইকেল, মোটরসাইকেলের মতো যানবাহনও সেই ছোট ডিঙিতেই পার হচ্ছে।
খেয়া ঘাটে নৌকার অপেক্ষায় ছিল নটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিথিলা ও তার দুই সহপাঠী। মিথিলা জানাল, তাদের বাড়ি পাটগ্রাম এলাকায়। বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে কয়েক মাইল পায়ে হাঁটতে হয়। পাড়ি দিতে হয় ডিঙি নৌকা।
মিথিলা বলল, ‘রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। একটু বৃষ্টি হলেই গর্ত-কাদায় হাঁটার উপায় থাকে না। শুকনো মৌসুমেও উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটা কঠিন। ছোট্ট ডিঙি নৌকায় খাল পার হতে ভয় লাগে। ডিঙিতে ৫ টাকা করে দিতে হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। পড়ালেখা করতে হলে এই পথেই প্রতিদিন যাতায়াত করতে হবে।’
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়াসিন হোসেন ও তার সহপাঠী সোহান বলল, তাদের বাড়ি পাশের ফরিদপুর জেলার সীমান্তের কাছাকাছি। স্কুলে যেতে প্রায় সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় বাইসাইকেলে। চরের রাস্তা এতই খারাপ যে সেখানে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করাও কঠিন। সেই পথে দুটি স্থানে ভাঙাচোরা বাঁশ-কাঠের সাঁকো পার হতে হয়। সাঁকো দুটিরই পাটাতন জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে। বছরের পর বছর মেরামত না হওয়ায় সাঁকো দুটিই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
মিথিলা, ইয়াসিন, সোহানসহ তাদের সহপাঠীদের দাবি, খেয়া ঘাটের জায়গায় একটি সেতু এবং সাঁকোগুলোর জায়গায় সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ করা হোক। পাশাপাশি চরের সড়কগুলো উন্নয়ন করা হোক। যাতায়াতের কষ্ট কমলে তাদের জীবন কিছুটা হলেও সহজ হবে।
নাটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ফয়সাল হোসেন বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট শতাধিক। চরের যাতায়াতব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। অনেক শিক্ষার্থীর বাড়ি বিদ্যালয় থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে। পাশের ফরিদপুর জেলার ফাকেরহাট এলাকার কয়েকজনও এই স্কুলের শিক্ষাার্থী। তাদেরও যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নটাখোলা পুলিশ ফাঁড়ির সঙ্গে লাগোয়া খেয়া ঘাটটি। এ ছাড়া নটাখোলা বাজার ও এনায়েতপুর বাজারসংলগ্ন এলাকায় রয়েছে দুটি কাঠের পাটাতনের সাঁকো, যেগুলো বহু ব্যবহারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
শিক্ষক ফয়সাল হোসেন বলেন, খেয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পেরিয়ে আমাদের ও শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। আর বৃষ্টি হলে যে কী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়, তা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। চরে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়া জরুরি। এখানে যে মানুষ বসবাস করে, সেটা হয়তো অনেকই মনে করে না। তা করলে চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা এত নাজুক হতো না।
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোতালেব খান বলেন, চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের যোগাযোগের জন্য নটাখোলা বাজারসংলগ্ন এলাকায় কাঠের সাঁকো রয়েছে। অনেক দিন ধরেই পাটাতন ভেঙে গেছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে সাঁকোটি। তার ওপর দিয়েই মানুষজনকে চলাচল করতে হচ্ছে। সাইকেল-মোটরসাইকেলও পারাপার হতে হচ্ছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
এই ইউপি সদস্য আরও বলেন, চরের রাস্তাঘাটের অবস্থাও অত্যন্ত বেহাল। মানুষজনের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এখন আবার পদ্মায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন কবলিত নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু পদ্মার চরাঞ্চলের দিকে কারও কোনো সুদৃষ্টি নেই। অবজ্ঞা-অবহেলায় আমরা চরাঞ্চলের মানুষ বসবাস করছি। গত ১৬ বছরে চরের অনেক উন্নয়ন কাজের কথা শুনেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই দেখতে পাইনি।
সারাবাংলা/টিআর