সম্প্রীতি সমাবেশে উপদেষ্টাদের প্রতি ‘ক্ষোভ’, নিরাপত্তা জোরদারের দাবি
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩১
রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় জেলা প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে ‘সম্প্রীতি সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে উপস্থিত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রতি ক্ষোভ জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নেতারা।
অন্যদিকে চীবর দান ও দুর্গা পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে নিরাপত্তা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠনসহ নিরাপত্তা জোরদারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে সভায়।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান।
সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক কে এস মং বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) রাতেও রাঙ্গামাটির মানুষ আতঙ্কে ছিল। কারণ উপদেষ্টাদের কাছ থেকে আমরা কোনো মেসেজ পেলাম না। তারা রাঙ্গামাটিতে এসে কোনো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি। উনারা আঞ্চলিক পরিষদ বা মসজিদ-কেয়াংসহ ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা পরিদর্শন করলে দেশের মানুষ ও পাহাড়ের মানুষ একটা মেসেজ পেত। আজ (রোববার) জেলা প্রশাসকসহ আপনারা সেসব স্থান পরিদর্শন করেছেন।’
কে এস মং আরও বলেন, ‘রাঙ্গামাটিতে সম্প্রীতি মিছিল করতে হলে জেলা পরিষদের প্রতিনিধি ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করুন। আমরা হাত ধরে দাঁড়ালেও একটা মেসেজ যাবে। আমরা সবাই অধৈর্য হয়ে গেছি। ঘটনার আগের দিন মশাল মিছিল থেকে প্রোগ্রামের প্রস্তুতি থাকলেও আপনারা কেন ব্যবস্থা নিলেন না? সামনে-পেছনে কোনো পুলিশ নেই কেন? পাহাড়ে কিছু হলেই পাহাড়ি-বাঙালি হামলা-দাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব কি এতই বিলুপ্ত হয়ে গেছে? আমরা সম্মিলিতভাবে এটাকে মোকাবিলা করতে চাই।’
সভা থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আসন্ন উৎসব দুর্গা পূজায় মণ্ডপ ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কঠিন চীরব দানোৎসবে বিহারগুলোতে নিরাপত্তা প্রদান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সম্প্রীতি সমাবেশ, ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় পরিবহণ শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, শহরে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার যানবাহন এবং বনরূপা বাজার দ্রুত সচল করা, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের জন্য এলাকা নির্ধারণ, আহতদের চিকিৎসা প্রদান, এলাকাভিত্তিক সম্প্রীতি কমিটি গঠন এবং গুজব নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপসহ নানা প্রস্তাব উঠে আসে।
এ সময় বক্তারা বলেন, সম্প্রীতি সমাবেশের আগে বর্তমান সংকটগুলোর নিরসন দরকার। শহরে যানবাহন চলাচল শুরু করা দ্রুত প্রয়োজন। আসন্ন দুর্গা পূজা ও বৌদ্ধদের চীবর দানোৎসবে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না পারে।
এদিকে রাত ৮টায় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে প্রশাসনের আশ্বাসে রাঙ্গামাটিতে ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।
শুক্রবারের সহিংসতার ঘটনার ফায়ার সার্ভিসের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বলেন, ‘ঘটনার দিন আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের বের হতে দেরি হওয়ার কারণ, আমাদের বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আমরা বের হতে পেরেছি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আমরা যেখানে আগুন নেভাব, সেখানে আমাদের যদি উশৃঙ্খল জনগণ পিটিয়েই মেরে ফেলে, তাহলে আমরা আমরা কীভাবে আগুন নেভাব?’
রাঙ্গামাটির সিভিল সার্জন ডা. নূয়েন খীসা বলেন, ‘হাসপাতাল হলো আমাদের কাছে এবাদতখানার মতো। কিন্তু এসব ঘটনায় এখন হাসপাতালে থাকা রোগীদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। শুক্রবারের সহিংসতায় ঘটনায় নিহত ব্যক্তিকে (জখমের কারণে) আমরা চিনতে পারছিলাম না। ৬টার পর আমরা তার পরিচয় পেয়েছি।’
সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি সদর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এরশাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমি ২০০৭ সাল থেকে পাহাড়ে আছি। এই অঞ্চলের প্রতি আমার একটা টান আছে। রাঙ্গামাটির মতো এমন সম্প্রীতির নজির খুব কম জায়গায় রয়েছে। এখানে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ আছে। কাজেই এখানে ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু সেই ঝামেলা এমন হবে, আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। আমাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখতে হলো। এটি যেন আর না হয়, আমরা সেই প্রত্যাশা করছি। কেউ যদি মনে করে আমরা চেষ্টা করিনি, তাহলে ভুল ধারণা। সব কিছু মিলিয়ে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমাদের দায়িত্ব পালনে কেউ কষ্ট পেলে আমরা দুঃখিত।’
পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এখানে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমরা লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। তদন্ত করছি। হত্যাকারী যারাই হোক, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। কিন্তু এখন আমাদের গুজবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গুজবের কারণে গতকাল (শনিবার) রাতেও আমাদের ঘুম হয়নি। আমরা প্রকৃত তথ্য চাই। বিভিন্ন জায়গা থেকে উসকানিমূলক পোস্ট করা হচ্ছে। রাঙ্গামাটি শহরটা অটোরিকশানির্ভর, এখানে অটোরিকশা বন্ধ থাকায় শহর মূলত অচল। অটোরিকশা চলাচল সচল করা জরুরি। এ ছাড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনতে চাই। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এগিয়ে যেতে হবে।’
সভায় সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘আমরা এলাকা অনুযায়ী সম্প্রীতি কমিটি করব। শহরের বনরূপা, রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি, কলেজ গেট ও ভেদভেদীতে সম্প্রীতি সমাবেশ হবে। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন হবে। ফেসবুকে যারা গুজব ছড়ায়, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেসহ বনরূপা ও রাস্তার ওপর কোনো সভা-সমাবেশ করা যাবে না। সমাবেশ হবে জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণ ও পৌরসভা চত্বরে। সভা-সমাবেশের আগে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। হত্যা মামলা হয়েছে। বেশি আহতদের আর্থিক অনুদান দেবো। নিহতের পরিবারকে সরকারি সহায়তা দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লেখা হয়েছে। শহরে সিসিটিভি বসানো হবে এবং হাসপাতালে নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে।’
সভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু, সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হারুন মাতব্বর, জেলা সিএনজি-অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি আলী বাবর, অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাবু, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রাজীব চাকমা, মৈত্রী বিহারের সাধারণ সম্পাদক অমৃত দেওয়ান, বনরূপা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আয়ুব চৌধুরী, রাজবন বিহারের সাধারণ সম্পাদক অমীয় খীসা, ছদক ক্লাবের সভাপতি প্রীতিময় চাকমা, জেলা জামায়াতের আমির আব্দুল আলিম, ইসলামী আন্দোলন রাঙ্গামাটি জেলার সেক্রেটারি নূর হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাঙ্গামাটির প্রতিনিধির মো. শাকিলসহ অন্যরা।
সারাবাংলা/টিআর
জেলা প্রশাসন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ রাঙ্গামাটি সম্প্রীতি সমাবেশ