Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কারওয়ান বাজারে প্রতিরাতে চাঁদাবাজি ৫০ লাখ, যুবদল নেতা বহিষ্কার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৩:১৪

ঢাকা: রাজধানীর কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজারে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে তেজগাঁও থানা আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব মো. আব্দুর রহমানকে বহিষ্কার করেছে যুবদল। ঘটনার নেপথ্যের ইন্ধনদাতা হিসেবে আরও এক নেতার নাম উঠে এসেছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাকেও বহিষ্কার করা হবে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সোহেলের সই করা এক বার্তায় আব্দুর রহমানকে বহিষ্কারের তথ্য জানানো হয়েছে। ওই বার্তার একটি কপি সারাবাংলার হাতে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, সরকার বদল হলেও বন্ধ হয়নি রাজধানীর বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজি। ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজের মদতে তেজগাাঁও থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সদস্যসচিব আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে কারওয়ান বাজারকে কয়েকটি স্পটে ভাগ করে আদায় করা হয় চাঁদা।

যুবদলের নেতাকর্মীরা বলছেন, যুবদলের বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা তুলছেন। রাত পোহালেই এই সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকছে ৫০ লাখ টাকা। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ ব্যবসায়ীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার মামলায় গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।

কারওয়ান বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নেতারা আত্মগোপনে চলে গেলে সরব হয়ে ওঠেন যুবদলের নেতারা। বর্তমানের তাদের নেতৃত্বেই কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি চলছে। চাঁদার পরিমাণও বেড়েছে। প্রকাশ্য না হয়ে তারা নিরবে চাঁদা তুলছেন। বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বেরিয়ে এসেছে চাঁদাবাজির বিশদ সব তথ্য। প্রতিদিন অন্তত পাঁচ হাজার পাইকারের আনাগোনায় মুখরিত কারওয়ান বাজারে পণ্য কেনা, পরিবহণে লোড করা, ভ্যান গাড়িতে পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই গুনতে নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। শুধু তাই নয়, পণ্য কিনে ট্রাকে লোড করার জন্য একটি স্থানে সেগুলো রাখার জন্য চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাবাজদের দাপটে ব্যবসায়ীরা অস্থির হলেও তাদের কাছে জিম্মি বলে নিরবে চাঁদা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চাঁদাবাজরা তাদের রাজত্ব দিন দিন বড় করেই চলছে।

প্রতিদিনের চাঁদার হিসাব

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য বলছে, সাধারণত প্রতিদিন কাওয়ান বাজারে আসা ট্রাক প্রতি চাঁদা তোলা হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা করে। প্রতি রাতে কারওয়ান বাজারে অন্তত ৪০০ ট্রাক পণ্য নিয়ে প্রবেশ করে। গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা ধরলে এক রাতে ট্রাক থেকেই চাঁদা ওঠে ৮০ হাজার টাকা।

ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে যেসব ভ্যানে তোলা হয়, সেগুলোকে চাঁদা দিয়ে হয় ৫০ টাকা করে। কারওয়ান বাজারে বর্তমানে ৭০০ ভ্যান গাড়ি রয়েছে। গড়ে প্রতিরাতে ৪০০ ভ্যান গাড়ি চালু থাকলেও এ খাত থেকে চাঁদা আসে ২০ হাজার টাকা।

বিভিন্ন আড়ত থেকে মালামাল কিনে সেগুলো আবার পিকআপে লোড করতে হলে পাইকারদের চাঁদা গুনতে হয়। পাঁচ হাজার পাইকার প্রতি রাতে ১০০ টাকা করে চাঁদা দিলেও তার পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ লাখ টাকায়।

সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানদারদের কাছ থেকেও আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। প্রতি রাতে এক হাজারের বেশি সবজির অস্থায়ী দোকান বসে, যেগুলো সকাল পর্যন্ত চালু থাকে। এসব দোকানের জায়গাও চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে। দোকান বসাতে হলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, তিন ফুট চওড়া ভাসমান দোকানের জন্য চার হাজার ও ছয় ফুটের দোকানের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া দোকানের জায়গা (ফুটপাত) বরাদ্দ পেতে অগ্রিম দিতে হয় অবস্থানভেদে ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসিক ভাড়া ছাড়াও প্রতি রাতে বসার জন্য এসব অস্থায়ী দোকানদারদেরকে আরও ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

এদিকে দিনে প্রধান চাঁদাবাজি হয় পার্কিংয়ের নামে। পার্কিংয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০টি স্পট নির্ধারণ করে সেগুলো ইজারা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কোনো ইজাদারাদার না থাকলেও পার্কিং ফি আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছামতো, যার এক টাকাও যাচ্ছে না সরকারের কোষাগারে। এ ছাড়াও জনতা টাওয়ার ও ক্রিসেন্ট মার্কেটের সামনে অবস্থান করা পিকআপ থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবন থেকে পার্কিংয়ের নামে চাঁদা আদায় করছে এ চক্র। কয়েকটি ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হোটেল লা-ভিঞ্চি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংক প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পার্কিংয়ের জন্য দেয়।

কারা করছে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ

সরকারের পরিবর্তনের পর ৫ আগস্ট থেকেই কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে নেন তেজগাঁও থানা যুবদলের সদস্যসচিব আব্দুর রহমান। পরে এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তাকে যুবদল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। তাতেও থামেনি আব্দুর রহমানের অপকর্ম।

দলীয় সূত্র বলছে, যুবদল মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজের মদতে আব্দুর রহমান তার বাহিনী নিয়ে নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সিন্ডিকেটে রয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মিলন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল নেতা ফারুক ওরফে ভাগিনা ফারুক, ইউছুফ মজুমদার ও সাদ্দাম খান এবং ৯ নম্বর ইউনিট বিএনপির নেতা মো. মুক্তার ও মো. মিলন পাটোয়ারি।

ব্যবসায়ীরা জানান, আব্দুর রহমানের সহযোগী ফারুক ওরফে ভাগিনা ফারুক ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়তের চারদিক, রাতে রাস্তার ওপর বসানের আড়ত এবং দিনে ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন। প্রতিদিন তার চাঁদা আদায়ের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার টাকা।

যুবদল নেতা সাদ্দাম খান প্রগতি টাওয়ারের পূর্ব পাশ থেকে সিএ ভবন মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। মো. ইউসুফের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পেট্রোবাংলা ভবন, বিটিএমসি ভবন ও জাহাঙ্গীর টাওয়ারের পেছনের গলি থেকে আম্বরশাহ মসজিদ গলি পর্যন্ত ফুটপাথ। এসব এলাকায় রাতে সবজি নিয়ে আসা ট্রাক-পিকআপ থেকে নেওয়া হয় দুই হাজার টাকা করে। প্রতিরাতে ট্রাক-পিকআপ থেকে তার আয় দুই লাখ টাকা।

বিএনপি নেতা মো. মিলন আবার নিয়ন্ত্রণ করেন আম্বরশাহ মসজিদের সামনে থেকে শুরু করে বাপেক্স ভবন, পানি উন্নয়ন ভবন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর ও কাব্যকস সুপার মার্কেট কাঠ পট্টি পর্যন্ত এলাকা। আব্দুর রহমানের আরেক সহযোগী মো. মিলন পাটোয়ারির নিয়ন্ত্রণে কারওয়ান বাজারে আসা পিকআপ গাড়ি। ২৭০টি পিকআপ থেকে মাসে ২৫০০ টাকা হারে আদায় হয় ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

কিচেন মার্কেটের পূর্ব পাশের ২ নম্বর সুপার মার্কেটের দক্ষিণ পাশ, কামার সেট ও মাছ বাজার থেকে চাঁদা আদায় করে মুক্তার হোসেন। আর যুবদল নেতা জসিম ওরফে কারেন্ট জসিম কারওয়ান বাজারের দিনের ফুটপাত ও রাতে রাস্তার ওপর বসানের সব আড়তে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে প্রতি বাতি থেকে ভাড়া আদায় করেন। অবৈধ এই বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে একদিকে সরকারের লাখ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে, অন্যদিকে ভারী হচ্ছে চাঁদাবাজদের পকেট।

এসব বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে কল করা হলে চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন আব্দুর রহমান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যবসা করে খাই। কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে একটি স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

যুবদল থেকে বহিষ্কারের কারণ জানতে চাইতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘একটি টেলিভিশনে আমার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করায় এ ঘটনা ঘটেছে।’ যুবদল নেতা সাজ্জাদুল মিরাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি তার অধীনে রাজনীতি করি।’

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

কারওয়ান বাজার চাঁদাবাজি চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট বহিষ্কার যুবদল নেতা

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর