অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে সেনাপ্রধান, দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:১২
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।বলেছেন, প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়া উচিত। সেই সময়টি হতে পারে দেড় বছর। এই সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য ‘যেকোনো পরিস্থিতি’তে এই সরকারের পাশে থাকবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। সাক্ষাৎকারে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও রাজনৈতিক ক্ষমতাগুলোর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়ে কাজ করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ওই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতাকে নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের তথ্য ঘোষণা করেন। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়।
সেনাপ্রধান রয়টার্সকে বলেন, ‘পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমি তার (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) পাশে থাকব, যেন তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন।’
ড. ইউনূসের দায়িত্ব বলতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দিকে ইঙ্গিত করেন জেনারেল ওয়াকার।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং বিরেধী দল বিএনপি তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলেছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দেড় বছর সময় থাকতে পারে বলে মনে করছেন সেনাপ্রধান। এর জন্য ধৈর্য ধরার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘আমার কাছে যদি জানতে চান, আমার কাছে মনে হয় একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য এ রকম একটি সময়সীমা (দেড় বছর) হওয়া উচিত।’
সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহের তার সাক্ষাৎ হয় এবং তাদের মধ্যে ‘অত্যন্ত সুসম্পর্ক’ রয়েছে। দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণই নেই।’
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে নানা সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর প্রভাব ও হস্তক্ষেপ এবং বিভিন্ন সময়ে সেনাশাসনের প্রসঙ্গও তুলে ধরেছে রয়টার্স। এ প্রসঙ্গে সেনাপ্রধানের ভাষ্য, তার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে দূরে থাকবে।
জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘আমি এমন কিছু করব না যা আমার সংগঠনের (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) জন্য ক্ষতিকর। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার বাহিনীকেও পেশাদার রাখতে চাই।’
দীর্ঘ মেয়াদেও সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার পক্ষে অভিমত জেনারেল ওয়াকারের। সেটি অর্জনের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।
সেনাপ্রধান বলেন, ‘এটি (সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা) কেবল তখনই হতে পারে যখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকবে। এ ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী সরকারি রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকতে পারে।’
বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সাধারণতই প্রধানমন্ত্রী পালন করে থাকেন। অন্তর্বর্তী সরকারেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার অধীন। সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এ বিষয়টিতে নজর দেওয়ার উচিত বলে সেনাপ্রধান মনে করেন।
জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘সামরিক বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত না। একজন সৈনিকেরও কোনোভাবেই রাজনীতিকে যুক্ত হয়ে পড়া উচিত নয়।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন খাতে সংস্কার এবং অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও অন্যায়-অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান সেনাপ্রধান। নাম প্রকাশ না করলেও তিনি বলেন, বাহিনীর কয়েকজনকে এরই মধ্যে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে।
জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘সেনাবাহিনীর কারও বিরুদ্ধে যদি অপরাাধ প্রমাণিত হয়, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব।’
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকার সময় অন্তত ৬০০ ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গুম বা হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও। বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা সংস্থাগুলোতে কাজ করার সময় বিচ্যুতিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকতে পারেন বলে মন্তব্য করেন সেনাপ্রধান।
সারাবাংলা/টিআর