Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নদী-বাজারে নেই ইলিশের দেখা, এবারও পূরণ হবে না রফতানি লক্ষ্যমাত্রা

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:১০

ঢাকা: আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রফতানিকারকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে যশোরের বেনাপোল দিয়ে ইলিশ রফতানি শুরুও হয়েছে। প্রকারভেদে কেজিপ্রতি ইলিশ ১০ থেকে ১৫ ডলারে রফতানি হচ্ছে।

যদিও ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর ভারতে ইলিশ রফতানি হতে পারে এক হাজার টন। কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই ইলিশ রফতানির লক্ষ্য পূরণ করতে পারছেন না রফতানিকারকরা। এবারও ইলিশ রফতানির পুরোটাই নির্ভর করছে সামনের একটি জো’তে (অমাবস্যা-পূর্ণিমা) কী পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়বে তার ওপর। এদিকে, ইলিশ রফতানির ঘোষণার প্রভাব পড়েছে বাজারে। কারণ, রফতানি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মজুত বাড়াচ্ছে ট্রলার মালিক ও আড়তদাররা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

ভারতে প্রতিবছর ইলিশ রফতানি করেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) পরিচালক ও এমইউসি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস। যশোরের এই ইলিশ রফতানিকারক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর এখনও ইলিশ রফতানি শুরু হয়নি। সরকার তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে। ১৩ অক্টোবর থেকে দেশে ইলিশ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ হচ্ছে। এরই মধ্যে ইলিশ রফতানি শুরু হয়েছে। কিন্তু বাজারে সেই অর্থে মাছ নেই। এ বছর নদীতে খুবই কম পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘গত বছর চার হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিলেও মাত্র এক হাজার টন রফতানি হয়েছিল। আমাদের প্রতিষ্ঠানকে ৮০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রফতানি করতে পেরেছিলাম মাত্র ২৭ টন। এ বছর এখনও মাছ কিনতে পারিনি, দামও প্রচুর। মনে হয়, এ বছর সবাই মিলে এক হাজার টন ইলিশ রফতানি করাও সম্ভব হবে না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছর এক কেজি ওজনের ইলিশ কিনতে ১৫০০ টাকা ও ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৪৫০ টাকা পড়ছে। আর ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ ডলারে প্রতিকেজি ইলিশ রফতানির চুক্তি হয়েছে। যে দাম দিয়ে চুক্তি হয়েছে কেনাই হয়তো এর চেয়ে বেশি পড়বে। ১৫ ডলারের নিচে এ বছর ইলিশ রফতানি করা সম্ভব হবে না।’

শ্যামল দাস বলেন, ‘বাজারে মাছ যে পাব না তা বুঝতে পারছি। ফলে ইলিশ রফতানি করে খুব বেশি লাভের সুযোগ দেখছি না। কারণ, এ বছর মাছের ল্যান্ডিং (পর্যাপ্ততা) খুবই কম। আর এ বছর আগে থেকে ইলিশ মজুত করে রাখারও সুযোগ হয়নি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে এমইউসি ফুডস লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকবলেন, ‘ভারতে ইলিশ রফতানির খবর এলেই বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়। এ বছরও বেড়েছে। ভারতে ইলিশ রফতানি হবে- এমন খবর পাওয়া মাত্রই ট্রলার ও আড়তের মালিকরা ইলিশ মজুত করে রাখে। ভারতে যদি রফতানি করা না যায় তখন তারা তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেয়। কৃত্রিম সংকট তৈরি করেও তারা ইলিশের দাম বাড়ায়। আবার এবার বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা না পড়ায় বাজারেও দাম বেশি রয়েছে।’

শীর্ষ ইলিশ রফতানিকারক প্যাসিফিক সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দোদুল কুমার দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে এখন ইলিশের দাম বেশি, সরবরাহও কম। মাত্র দু’দিন হলো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আরও আগে অনুমতি দেওয়ার দরকার ছিল। এখন ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিনই বর্ডারে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘ভারতীয় আমদানিকারকদের সঙ্গে এখনও ইলিশের দাম নির্ধারণ করিনি। প্রতিবছরই রফতানি করি, তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। ১০ ডলারে নিচে হলে এবার ইলিশ রফতানি করে লাভ তুলতে পারব না। ছোট সাইজের ইলিশ অর্থাৎ ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম বা এক কেজির নিচের ইলিশ হয়তো কেজিপ্রতি ১০ ডলারে রফতানি করা যাবে। এক কেজি বা তার উপরের সাইজের ইলিশ হয়তো ১৫ ডলারে রফতানি করা সম্ভব হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশে ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ হবে। তার আগে একটি জো (অমাবস্যা-পূর্ণিমা) রয়েছে। তখন যদি বেশি মাছ ধরা পড়ে তাহলে হয়তো প্রচুর পরিমাণে ইলিশ রফতানি করা সম্ভব হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ জো’তে (৩ থেকে ৪ দিন আগে) ১৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কিনতে হয়েছে ১৭৫০ টাকায়, ১২০০ গ্রাম ১৪৫০ টাকা ও এক কেজি সাইজের ইলিশ ১২৫০ টাকায় কেনা গেছে। সামনে একটি জো রয়েছে। তখন হয়তো এই দামেই ইলিশ কেনা যাবে। জো শুরু হলে ৬ থেকে ৭ দিন ইলিশ রফতানি করা যাবে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘ভারতে আমরা যখন সব রফতানিকারক একসঙ্গে ইলিশ রফতানি করি তখন কলকাতার বাজারে ইলিশের দাম কমে যায়। ফলে দুর্গাপূজায় ইলিশের দাম কম থাকে।’ অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘গত বছর আমার দুই প্রতিষ্ঠানকে ৮০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছিল। রফতানি করতে পেরছিলাম মাত্র ৪০ টন। এ বছর সব রফতানিকারকদের তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হলেও হয়তো এক হাজার টন রফতানি হতে পারে।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) পরিচালক ও আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, ‘গত বছর আমি ইলিশ রফতানি করেনি, তার আগের বছর (২০২২ সাল) করেছিলাম। সে বছর লোকসান হওয়ায় গেল বছর (২০২৩ সালে) আবেদন করেনি। এ বছর দেশেই ইলিশের দাম বেশি। ফলে সস্তায় কিনে রেখে মজুদ করে রাখা যায়নি। সাধারণত অনেক রফতানিকারক ৫০ থেকে ১০০ টন কিনে মজুত করে পরে রফতানি করে থাকি। কিন্তু এ বছর লোকাল মার্কেটেই এক কেজি বা তার কাছাকাছি ওজনের ইলিশের দাম ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি। আবার ভারতেও দাম কম। কারণ, মিয়ানমার থেকে ভারতে প্রচুর ইলিশ যায়। ভারতের ব্যবসায়ীরা এখন মিয়ানমার থেকে ইলিশ আমদানি করছে। আবার নদী থেকে চোরাই পথে ভারতে প্রচুর ইলিশ পাচার হচ্ছে।’

এ বিষয়ে বিএফএফইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আশরাফ হোসাইন মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর সীমিত আকারে ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়। সেভাবে সংগ্রহ করতে না পারলে অনুমোদিত কোটা পূরণ করা যায় না। এ বছর তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দিয়েছে, সেই লক্ষ্য পূরণ হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। কারণ, গত দুই বছর কোনো রফতানিকারই ইলিশ রফতানির লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি এবং লাভও হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভারতে ইলিশ রফতানি হয় কাঁচা মাছ হিসেবে। বরফে করে দেশের মতোই ভারতে দ্রুত সময়ে ইলিশ রফতানি করা যায়। হয়তো কোয়ালিটি কিছুটা নষ্ট হয়।’

বন্ধ হচ্ছে ২২ দিনের জন্য ইলিশ সংগ্রহ, বিক্রি ও বিপণন

২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরা ও বিক্রিতে অবরোধ আসছে। দেশে মা ইলিশ রক্ষায় আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, পরিবহণ, বিপণন ও মজুদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে, ভরা মৌসুমে বাজারে ইলিশ পাওয়া যাবে আর মাত্র ২০ দিন। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বরের পর থেকে বাজারে আবারও ইলিশ বিক্রি শুরু হবে। তখন আর ইলিশের ভরা মৌসুম থাকবে না। থাকবে না ইলিশের সেই স্বাদও।’

৪৯ প্রতিষ্ঠানকে ২৪২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি

ভারতে ইলিশ রফতানি করতে ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠান ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি পেয়েছে। বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তারের সই করা এক অফিস আদেশ থেকে এ তথ্য জানা যায়।

ইলিশ রফতানির আদেশে রফতানিকারকদের আটটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শর্তে বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানই অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি রফতানি করতে পারবে না। এ অনুমতির মেয়াদ আগামী ১২ অক্টোবর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।’ আর ৪৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৮ টিকে ৫০ টন করে ও একটি প্রতিষ্ঠানকে ২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সরকার ৩ হাজার টন ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নিলেও ৪৯টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেওয়া সম্ভব হয়েছে। রফতানিকারকরা জানান, আগে থেকে ঘোষণা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।’

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে আবেদনগুলো পড়েছে, যাদের ডকুমেন্ট ঠিক ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ইলিশ রফতানির বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে

দেশে প্রতিবছরই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ১০ বছর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন, সেখানে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৭১ হাজার টনে। সর্বশেষ টানা ছয় বছর ধরে দেশের ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ টনের উপরে রয়েছে।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ লাখ ৯৬ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন।

৫ বছরে ভারতে ইলিশ রফতানি সাড়ে ৫ হাজার টন

গেল বছরে ভারতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন ইলিশ রফতানি হয়েছে। তথ্যবিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতে যে পরিমাণ ইলিশ রফতানি হয় তা দেশের মোট ইলিশ উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ। আর সরকার প্রতিবছর যে পরিমাণে ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেয় সেই লক্ষ্য কোনো বছরই পূরণ হয় না। গেল ৫ বছরে গড়ে ১ হাজার টন করে ইলিশ রফতানি হয়েছে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

ইলিশ পূরণ রফতানি লক্ষ্যমাত্রা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর