ড. ইউনূসকে কতদিন সময় দেবে বিএনপি?
১ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৩৫
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ক্ষমতায় বসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস পূর্ণ না হতেই বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, ইউনূসকে খুব বেশি সময় দিতে চান না তারা। নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের এক ধরনের ইঙ্গিত দিলেও এ সময়টাকেও ‘বেশি’ হিসেবে দেখছে বিএনপি।
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরাসরি না বললেও ‘যৌক্তিক সময়ে’র মধ্যে নির্বাচন দিয়ে ‘মানে মানে কেটে পড়া’র পরামর্শ দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের। তারা যে সংস্কারের কথা বলছেন, সেটা ‘রাজনীতিকদের কাজ’— এটা পরিষ্কার করেই বলছেন বিএনপি নেতারা।
দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে রেখেছে বিএনপি। এই সমর্থনও একটি ‘যৌক্তিক সময়’ পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে তারা। কিন্তু কালক্ষেপণ করলে ভোটাধিকারের জন্য ফের মাঠে নামতে দ্বিধা করবে না বিএনপি। সরকার পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্টের প্রথম সমাবেশ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যতগুলো সভা-সমাবেশ হয়েছে, তার প্রতিটিতেই একই বার্তা দিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এর জন্য যতটুকু সময় দরকার, ততটুকু আমরা দেবো। তবে তাদের খেয়াল রাখতে হবে, সময়টা যেন যৌক্তিক সীমার মধ্যে থাকে। অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব নিয়ে কালক্ষেপণ দেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেবে না। অনেক রক্ত ঝরিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে পথ তৈরি হয়েছে, সেটা যেন আবার রুদ্ধ না হয়ে যায়।’
সূত্রমতে, বিএনপি মনে করছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও বিচার বিভাগ সংস্কার প্রয়োজন। এসব জায়াগায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংস্কারের প্রস্তাবনা এনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সংবিধান সংস্কারের মতো বড় কাজে হাত দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ঠিক হবে না। এটি করতে গেলে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হবে। এ কারণে সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়ে বিএনপি শুরু থেকেই উষ্মা প্রকাশ করে আসছে।
সংবিধান সংস্কার নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরও। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার— সংবিধান সংস্কারের কাজ নির্বাচিত সরকারের হাতে থাকতে হবে। এটি অনির্বাচিত সরকার বা তথাকথিত এলিট শ্রেণির হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। অতি উৎসাহী হয়ে এ কাজ করতে গেলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। এরই মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, ‘সংবিধান পুনর্লিখন করতে গেলে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হবে। সেটি মুক্তি যুদ্ধ নয়, মহাযুদ্ধ।’
ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেকের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন। এসব কমিশন নিয়ে এরই মধ্যে নানা বিতর্ক ছড়িয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিককে। শেষ পর্যন্ত তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষক আলী রিয়াজকে, যিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।
বিএনপি মনে করে, এসব কাজে হাত দিয়ে কালক্ষেপণের পাশাপাশি নতুন করে বিতর্ক তৈরি করা যুক্তিসঙ্গত নয়। কাজগুলো নির্বাচতি সরকারের হাত দিয়ে হওয়াটাই শ্রেয়। আগ বাড়িয়ে এসব কাজ হাতে নিয়ে শেষ করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমবে। এসব প্রক্রিয়া ছয় মাসের মধ্যে শেষ করে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন শেষ করা উচিত বলেও মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজনের জন্য এক বছর সময় যথেষ্ট। তবে আমরা নির্ধারিত কোনো দিন বা মাসের কথা বলছি না। আমরা বলছি কয়েকটি জায়গায় প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করতে।’
তিনি বলেন, ‘সবাই বুঝতে পারছে এবং আমরাও বুঝতে পারছি যে কিছু সময় লাগবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে, যেন আমরা বুঝতে পারি কবে নাগাদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দেশ ফিরে আসবে। দেশবাসীও এটি নিশ্চিত হতে চায়। তবে আমরা নির্দিষ্ট কোনো সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে বেঁধে দিচ্ছি না।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, কৌশলগত কারণে বিএনপি এখন সরাসরি কিছু না বললেও দলটি প্রকৃতপক্ষেই চায়, যত দ্রুতসম্ভব নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ‘মানে মানে কেটে পড়ুক’। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়া এ দেশ পরিচালনা করা সম্ভব না— এমনটিও ঘোর বাস্তবতা বলেই মনে করেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করে দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে হলে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে আকস্মিকভাবে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিকল্প ছিল না, সেটা আমরা সবাই জানি। সঙ্গত কারণে তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন সেদিনও ছিল, আজও আছে। তাদের প্রতি আমাদের আস্থাকে প্রশ্নহীন রাখার চ্যালেঞ্জ তাদেরই নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব আর সেটি যথার্থভাবে প্রতিপালনের রোডম্যাপ তাদেরই নির্দিষ্ট করতে হবে। সব পরিবর্তন সাধন যেমন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি এমন দায়িত্বও তাদের কাঁধে নেওয়া সঙ্গত হবে না যেটা তারা বহন করতে সক্ষম হবেন না।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয়-নির্বাচন ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি সংসদ নির্বাচন