‘বন্দরখেকো’ শাজাহান-লতিফ
৩ অক্টোবর ২০২৪ ২২:২০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর দুই মেয়াদে টানা প্রায় ১০ বছর নৌ পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিক শাজাহান খান। একই সময় থেকে টানা ১৫ বছর চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন ব্যবসায়ী নেতা হয়ে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করা এম এ লতিফ। দেশের অথর্নীতিতে অন্যতম অবদান রাখা চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান এ আসনে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শুরু থেকে চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে শাজাহান-লতিফের জুটি ছিল তুমুল আলোচিত। বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের বড় অংশের অভিযোগ, ১৫ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে যত লুটপাট-অনিয়ম হয়েছে, তা আগে কখনোই হয়নি। আর এর সবটুকুই হয়েছে শাজাহান-লতিফের যোগসাজশে; তাদের সঙ্গে থাকা দলটির নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে।
দৃশ্য-অদৃশ্য বিভিন্ন খাতে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং বন্দরের একশ্রেণির কর্মকর্তা হাজার-হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি খোদ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একাংশও বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। কিন্তু সরকার কখনোই এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে তদন্ত কিংবা প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে দৃশ্য-অদৃশ্য খাতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ‘কাগজে-কলমে’ অনেকটাই ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছেন জড়িতরা।
এ পরিস্থিতিতে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে গত ১৫ বছরের খাতভিত্তিক অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা এস এম সাইফুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্দরে কেনাকাটা, টেন্ডার, মালামাল পাচার, সাপ্লাই— এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি হয়নি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত, সেটা মন্ত্রণালয় বলেন আর স্থানীয় সংসদ সদস্য বলেন কিংবা দলটির নেতাকর্মী বলেন, সবাই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। বন্দর প্রশাসনের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিরাজ করে ওয়ান টু অল, তারা সবাই বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন।’
‘এখন আমাদের দাবি হচ্ছে, লুটপাটের তদন্ত হোক। কোন কোন খাতে কিভাবে, কি প্রক্রিয়া লুটপাট হয়েছে এবং এর সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে কারা কারা জড়িত সেটা বের করা হোক ও তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক,’— বলেন ব্যবসায়ী নেতা সাইফুল আলম।
সংসদ সদস্য হওয়ার সময় এম এ লতিফ আওয়ামী লীগে নবাগত ছিলেন। ২০০৮ সালের শেষ ভাগে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বন্দর-পতেঙ্গা আসনে আকস্মিক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ওই সময় চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি থাকা লতিফ। দলের এ সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীরাও বিস্মিত হন। আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ নেতা হিসেবে পরিচিতি পেলেও ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও লতিফকেই তাদের প্রার্থী হিসেবে রাখে দলটি। একতরফা নির্বাচনগুলোতে সহজেই জিতে আসেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পর ৯ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন লতিফ। ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আটক হন সাবেক নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খান।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক-বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা ও বন্দর ব্যবহারকারী কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই এম এ লতিফ চট্টগ্রাম বন্দরে আধিপত্য বিস্তারকে নিজের লক্ষ্য হিসেবে নেন। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হওয়ায় তিনি কিছুটা বাড়তি সুযোগও পান। তবে শুরুতে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা (বর্তমানে প্রয়াত) ডা. আফছারুল আমিন চৌধুরী। তিনি সাবেক মেয়র (বর্তমানে প্রয়াত) এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। মহিউদ্দিন-আফছারুলের বিরোধিতার কারণে লতিফ শুরুর দিকে তেমন সুবিধা করতে পারেননি।
এর মধ্যে আফছারুল আমিনকে সরিয়ে শাজাহান খানকে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আর লতিফকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দুজনের সখ্যতায় গড়ে ওঠে বন্দর নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট, যার মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন বার্থ অপারেটর, বন্দরের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চট্টগ্রামের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি ছিলেন।
সংসদ সদস্য লতিফ নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এর সুবাদে বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসার বেশির ভাগই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। অভিযোগ আছে, বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল পরিচালনার অপারেটর নিয়োগেও এমপি হিসেবে লতিফের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি বড় ফ্যাক্টর ছিল। নৌপথে পণ্য পরিবহণে নিয়োজিত লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) ঘিরেও চলত লতিফের বাণিজ্য।
অবসরে যাওয়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনারা যেভাবে প্রভাবটা বিস্তার করতেন এবং অবৈধ সুবিধা আদায় করতেন, সেটা একেবারে বন্দরের শীর্ষপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে হতো। এর নিচে সেটা দৃশ্যমান ছিল না। সেগুলো ছিল এমন— টেন্ডারের ক্ষেত্রে আগে থেকে নিজস্ব ঠিকাদার নির্ধারণ করে দেওয়া এবং সেই প্রতিষ্ঠান যেন কাজটা পায়, সেজন্য আড়ালে সব ধরনের সুযোগ তৈরি করে রাখা।’
‘বন্দরে প্রচুর কন্ট্রাক্টর জেনারেটেড ওয়ার্ক হয়েছে। অর্থাৎ বন্দরের প্রয়োজন নেই কিন্তু ঠিকাদার নিজের পছন্দে প্রজেক্ট বানিয়ে নিয়ে এলেন, সেটা পাস হয়ে গেল ও ঠিকাদার টাকা নিয়ে গেলেন। এমন কাজ হলে আমরা বুঝতাম, সেগুলো স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক তদবিরের কাজ। এ ছাড়া বন্দর যেসব কেনাকাটা করত, সেটা দেশীয় বাজার কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে হোক, সেগুলোর জন্য পছন্দের ঠিকাদার আসতেন ওই সুনির্দিষ্ট জায়গা থেকে,’— বলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা।
বন্দরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সাবেক ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারের বাইরে আরও কিছু কাজ ছিল, যেগুলো উনারা নিজস্ব আধিপত্যের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন। যেমন— কনটেইনারের ক্যারেট (কাঠ) বিক্রি। এরপর বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজে মালামাল সরবরাহ। কোনো কোনো জাহাজে ১০-১৫ লাখ টাকার মতো মালামাল সরবরাহ করতে হয় বাইরের বাজার থেকে কিনে। সেখানে এমপি সাহেবের লোকজন ছাড়া কেউ ঢুকতেই পারেনি।’
‘এরপর শিপ হ্যান্ডেলিং অপারেটর করা হলো ৩২-৩৩ জনকে। এটা সাবেক মন্ত্রী (শাজাহান খান) করে গেছেন। একেবারে অন্যায় কাজ হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগের লোক বিবেচনায় কতগুলো অনভিজ্ঞ লোককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এমনিতে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক যেসব কাজ, সেখানে মন্ত্রী-এমপিরা হস্তক্ষেপ করতেন না। কিন্তু যেগুলোর সঙ্গে ছোট-বড় যেকোনো অঙ্কের লাভের বা উপার্জনের যোগসাজশ আছে, সেগুলো উনাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া হতো না।’
জানা গেছে, আমদানি পণ্য নিয়ে আসা জাহাজে কনটেইনারের ভেতরে এক ধরনের কাঠের কাঠামো থাকে। সেই কাঠামোর মধ্যে নেওয়া হয় আমদানি পণ্যের বাক্স বা কার্টন। গভীর সাগরে ঢেউয়ের কারণে কনটেইনারের ভেতরে থাকা পণ্য স্থানচ্যুত হয়ে যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য এই কাঠের কাঠামো দিয়ে কনটেইনারের ভেতরটা সাজানো থাকে। কনটেইনার থেকে পণ্য খালাসের পর সেই কাঠের কাঠামোগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ভেন্ডর লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সেগুলো সংগ্রহ করে বন্দরের ইয়ার্ডকে পরিত্যক্ত আবর্জনামুক্ত করে।
সূত্রমতে, গত ১৫ বছরে সাংসদ এম এ লতিফের অনুসারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পরিত্যক্ত কাঠের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছে। একেকটি জাহাজ থেকে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকার কাঠ পরিত্যক্ত হিসেবে বের হয়। লতিফের লোকজন সেগুলো সংগ্রহ করে বাইরে বিক্রি করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। এরপর বন্দরের ইয়ার্ডে থাকা কনটেইনার পণ্য খালাসের পর ভালোভাবে পরিস্কার করতে হয়। ১৫ বছর ধরে কনটেইনার ক্লিনিংয়ের ব্যবসারও নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে।
অভিযোগ আছে, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের একটি সিন্ডিকেট ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে, যারা ছিলেন লতিফের ঘনিষ্ঠ। এদের মধ্যে বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গতিবিধি নজরদারিসহ দিনের সব খবরাখবর আদায় করা হতো। ছোট-বড় টেন্ডারও তাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবাধ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছিল।
এদের মধ্যে আলোচিত একজন চট্টগ্রাম বন্দর সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক নায়েবুল ইসলাম ফটিক। তিনি বন্দরের নৌ বিভাগের লস্কর পদ থেকে থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বন্দর-পতেঙ্গা আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ লতিফের পক্ষে তিনি সরাসরি কাজ করেন। বন্দরের বিভিন্ন বিভাগে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি বন্দরের ঠিকাদারি ব্যবসাসহ নানা ব্যবসায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।
১০ বছর দায়িত্ব পালনকালে নৌ পরিহণমন্ত্রী হিসেবে শাজাহান খান সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছিলেন নিয়োগ নিয়ে। অভিযোগ আছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে একদিকে তিনি নিজ নির্বাচনি এলাকা মাদারীপুরের লোকজনকে একচ্ছত্র প্রাধান্য দিয়েছেন, অন্যদিকে বহু নিয়োগে অবৈধ লেনদেন হয়েছে।
শাজাহান খানের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের নভেম্বরে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিলেন নিজ দলের নেতা সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ সময় শাজাহান খান ও এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ বার্থ অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক ও এর মালিক রহুল আমিন তরফদারকে কালো তালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। একই সময়ে শাজাহান খানের আমলে নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক আমিরুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে এত লুটপাট আগে আরও কখনো হয়নি। ১৫ বছর ধরে একই বার্থ অপারেটর, নতুন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বন্দরের কোয়ালিটি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নিজেদের মানুষজনকে কাজ পাইয়ে দিতে ইচ্ছামতো টেন্ডারের শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। এক কথায় দেদারসে লুটপাট চলেছে। মন্ত্রী করেছেন, এমপি করেছেন, উনাদের সঙ্গে বন্দরের বড় বড় কর্মকর্তা, বার্থ অপারেটর, নেতা— মোটামুটি যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবে লুটপাট করেছে।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর