নদী গিলে খাচ্ছে বসতভিটা-স্থাপনা, নবগঙ্গার ভাঙনে আতঙ্কে শত পরিবার
৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১১
নড়াইল: বর্ষা মৌসুমের শেষ ভাগে এসে নবগঙ্গা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। তিন সপ্তাহ ধরে অব্যাহত ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গেছে অর্ধশতাধিক বসতভিটার কাঁচাপাকা ঘর, গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে গ্রাম ছেড়ে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নিতে হয়েছে তাদের। এখনো ভাঙনের মুখে রয়েছে তিন শতাধিক বসতবাড়ি, পাকা রাস্তা, কবরস্থান, মসজিদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এতে উদ্বেগ ও আতঙ্কে রয়েছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। জন্য ছুটছেন অনেকেই।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নবগঙ্গার নদীপাড় তীব্র ভাঙনের কবলে পড়ে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে কালিয়া উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রাম থেকে শুরু হয় ভাঙন। এর পর থেকে প্রতিদিনই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থাপনা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে ভাঙছে নবগঙ্গা নদী। বিষ্ণপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মো. ইমদাদ মাস্টার জানালেন, ছোটবেলা থেকেই নবগঙ্গার পাড়ের বাসিন্দা তিনি। জীবনের বেশির ভাগ সময় নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। প্রতি বছরই তার ফসলি জমি, বসতভিটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তাকে হারাতে হয়েছে নদীগর্ভে। গত সপ্তাহেও তার নির্মাণ করা শেষ বাড়িটি নদীর পেটে চলে গেছে।
মো. ইমদাদ বলেন, ‘আমি তিনটি বাড়ি নির্মাণ করেছি। একটি বাড়িতেও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারিনি। তিনটি বাড়িই বিভিন্ন সময় নদীগর্ভে চলে গেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার জীবনের সব উপার্জন দিয়ে যে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলাম, ভিটেমাটিসহ সেটিও গত সপ্তাহে নদীগর্ভে চলে গেছে।’
‘নদীর কাছে হার মানতে মানতে এখন অসহায় হয়ে পড়েছি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাথা গোঁজার মতো এক শতক জমিও আর অবশিষ্ট নেই। জীবনের বাকি দিনগুলো হয়তো রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায় অথবা খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে,’— হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন এই শিক্ষক।
কেবল ইমদাদ মাস্টার নয়, কালিয়া উপজেলার হাজারও বাসিন্দার অভিজ্ঞতাও একই। প্রতিবছরই নবগঙ্গা নদীর কোনো না কোনো পাড় ভাঙে। বাসিন্দারা হারান বসতবাড়ি, স্থাপনা। স্থানীয় রাস্তাঘাট, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনাও প্রতি বছরই একটু একটু করে নদীতে বিলীন নয়, এ বছরও যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে গত তিন সপ্তাহ আগে।
নবগঙ্গাপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, এ মৌসুমে অব্যাহত ভাঙনে এরই মধ্যে বিলীন হয়েছে একই গ্রামের রিলু ফকির, জনি শেখ, মাহাবুর ফকির, মাকসুদ ফকির, রুকি বেগম, জহুর সরদার, শহিদুল মোল্লা, মহাদাদ শেখসহ অন্যদের প্রায় অর্ধশত বসতভিটা। খোকন মোল্লা, শাহাদাদ সরদার, সাইফুল সরদার, কিবরিয়া শেখ, বিল্লাল সরদার, পারভেজ সরদার, আরিফ সরদার, সেতু মোল্লাসহ শত শত মানুষের ঘরবাড়ি এবং কবরস্থান, মসজিদ, পাকা রাস্থাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে ভাঙনের মুখে।
মাকসুদ ফকির বলেন, বাড়িতে দুটি থাকার ঘর, একটি গোয়াল ঘর ও একটি রান্নাঘর ছিল। গাছপালা, ভিটেমাটিসহ সব নদীতে চলে গেল। অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখলাম। কিছু ঠেকাতে পারলাম না।
রুকি বেগম বলেন, আমার সাজানো সংসারের সব নদী নিয়ে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই। নতুন করে বাড়ি করার মতো আর কোনো জমি আমার নেই। এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বিষ্ণুপুর গ্রামের মুদি দোকানি আল আমিন সরদার বলেন, নদী আমার মুদি দোকানটা গিলে খেয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগে দোকানসহ দোকানের সব মালামাল নদীতে চলে গেল। দোকানটা ছিল আমার একমাত্র উর্পাজনের উৎস। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখন কী করব, জানি না।
আরেক দোকানদার মিল্লাদ সরদার বলেন, চোখের পলকে আশপাশের বাড়িঘরসহ আমার দোকান নদীতে ভেঙে গেল। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কারও কিছু করার ছিল না।
ভাঙনের আতঙ্কে থাকা খোকন মোল্লা বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির পাশে চলে এসেছে। যেকোনো সময় আমার ভিটে নদীতে চলে যাবে। রাতে ঘুমাতে পারি না। ছেলেমেয়েকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বার বার ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিরা নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। আশ্বাস নয়, এবার সত্যি সত্যি নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে— এটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোর পানি উন্নয়ন সার্কেল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সাবিবুর রহমান বলেন, আমি নিজে ভাঙন কবলিত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। ভাঙন রোধে জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ দিয়ে নদী ভাঙন রোধের প্রাথমিক চেষ্টা করা হবে। ভাঙন কবলিত এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্পও তৈরি করা হবে। অনুমোদনসাপেক্ষে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
সারাবাংলা/টিআর