কালুরঘাট সেতু: ৩ দশকের আশায় ‘আলো’ ফুটল ২ মাসে
৭ অক্টোবর ২০২৪ ২২:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাড়ে তিন দশক ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কোটি মানুষ যে সেতুর আশায় দিন গুনছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সেই আশার ফুল ফুটেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্প। এর মাধ্যমে কর্ণফুলীর বুকে বহুল প্রত্যাশিত রেলসহ সড়ক সেতুটি নির্মাণের পথে সব বাধা দূর হলো, অবসান ঘটল দীর্ঘ অপেক্ষার।
একনেক অনুমোদন দেওয়ার পর এখন রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নতুন সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ সেই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। তবে সেতু নির্মাণের মূল কাজ শুরুর যাত্রাপথে আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বাধাবিঘ্ন যেন না আসে, সেদিকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছে সেতুর দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করে আসা বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ।
সোমবার (৭ অক্টোবর) অন্তবর্তী সরকারের দ্বিতীয় একনেক সভায় ১১টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সরকারের খরচ ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৪১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এই ১১টি প্রকল্পের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্প, যাতে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে রেল কর্তৃপক্ষ।
সূত্রমতে, সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে সহজ শর্তে ৮১ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার ডলার ঋণ পাচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসেবে)। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ) তহবিল থেকে ৯ কোটি ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার ঋণ দেওয়া হচ্ছে এই সেতুর জন্য।
ইডিসিএফের আওতায় ঋণচুক্তির সুদের হার ০.০১ শতাংশ এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাড়ে ১৫ বছর, গ্রেস পিরিয়ডসহ সাড়ে ৪০ বছর। ইডিপিএফ তহবিলের আওতায় ঋণচুক্তির সুদের হার ১ শতাংশ ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাত বছর, গ্রেস পিরিয়ডসহ মেয়াদ ৩০ বছর। সুদের হার ও শর্তাবলি উভয় ঋণের ক্ষেত্রেই নমনীয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণের পর বাকি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত ২৭ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। তখন রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, জুলাইয়ে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হবে। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রবল গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে কি না, তা নিয়েই নানামুখী আলোচনা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি দ্রুততার সঙ্গে একনেকে অনুমোদন দেওয়ায় এ ক্ষেত্রে আশা জাগানিয়া অগ্রগতি হয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
কালুরঘাট সেতুর প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. গোলাম মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘একনেকে অনুমোদন মানে অনেক বড় অগ্রগতি। এবার আমাদের মূল কাজ শুরু হবে। শিগগিরই আমরা কনসালট্যান্ট নিয়োগ করব। বিস্তারিত নকশা হবে। এটা করতে এক বছরের মতো লাগবে। এরপর আমরা দরপত্র আহ্বান করব। তার জন্য আরও ছয় মাস লাগবে। এরপর ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজ শুরু হবে।’
‘আশা করছি, ২০২৬ সালের প্রথম তিন-চার মাসের মধ্যে আমরা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারব। ২০৩০ সালে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে রেল ও সড়ক পথ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে,’— বলেন গোলাম মোস্তফা।
পরামর্শক নিয়োগ, বিস্তারিত নকশা ও দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ভূমি অধিগ্রহণের কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের কাজটা আমরা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে শুরু করে দেবো। সেতুর জন্য আমাদের মোট ১৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ রেলওয়ের মালিকানাধীন ও সরকারি খাসজমি। এটা আমাদের জন্য বেশ সুবিধা হয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশের মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি। সেগুলো মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে অধিগ্রহণ করাটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।’
কালুরঘাট সেতুর প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেলসেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মিত হবে। সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্য পাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬ কিলোমিটার।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নতুন সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে প্রতিদিন ২০ জোড়া ট্রেন ও দিনে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। এর মাধ্যমে আনুমানিক এক কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে।
এদিকে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হওয়ার পর বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ বিবৃতি দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও রেলপথ উপদেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। পরিষদের বিবৃতিতে আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতায় পড়ে সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারের বিশেষ দৃষ্টি চাওয়া হয়েছে।
বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তরিকতা থাকলে কোনো কাজই যে অসম্ভব নয়, সেটা অন্তর্বর্তী সরকার প্রমাণ করেছে সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি মাত্র দুই মাসের মধ্যে অনুমোদন দিয়ে। আশির দশক থেকে অন্তত চার দশক ধরে মানুষ সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একজন সংসদ সদস্য সেতু নির্মাণ করা না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। এখন আমরা চাই, অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতায় সেতুটির নির্মাণকাজ প্রত্যাশিত সময়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন হোক।’
সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তফা নঈম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোটি মানুষের দাবি দুঃখজনকভাবে রাজনৈতিক সরকারের আমলে অর্থায়ন, নকশাসহ নানা জটিলতাকে সামনে এনে আটকে রাখা হয়েছিল। অনেকটা এক পা এগোলে ১০ পা পিছিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল। শেষ পর্যন্ত প্রাণের দাবি একনেকে অনুমোদন দেওয়ায় নোবেলজয়ীর সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের অনুরোধ থাকবে, আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা কিংবা কালক্ষেপণ যেন না হয়। সরকারের বিশেষ নজর প্রত্যাশা করছি।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর