এখনো হয়নি বেড়িবাঁধ, পদ্মার ভাঙনে দিশেহারা কাঞ্চনপুর
৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:২২
মানিকগঞ্জ: পদ্মার তীব্র ভাঙনে ক্ষত-বিক্ষত মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন। জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকায় বেড়িবাঁধ পায়নি ইউনিয়নবাসী। ফলে বছরের পর বছর ধরে ভিটেমাটি রক্ষার লড়াই করতে করতে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত পদ্মাপাড়ের মানুষ। গত কয়েক দশকে সেই লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে অসংখ্য পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন। স্থায়ী ঠিকানা হারিয়ে বেছে নিতে হয়েছে অন্যের আশ্রয়।
কাঞ্চনপুর ইউনিয়নে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এই ইউনিয়নের মোট ১৩টি মৌজার মধ্যে ১২টি মৌজা পদ্মা গিলে খেয়েছে। একটি মৌজাই কেবল অবশিষ্ট, তারও প্রায় তিন-চতুর্থাংশ চলে গেছে নদীগর্ভে। বাকি এক ভাগও রয়েছে ভাঙনের হুমকিতে। ভাঙন রোধে এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বাররা উচ্চ মহলের দ্বারস্থ হলেও কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান নয়। দায়সারাভাবে কিছু বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে, তবে সেটিও কোনো কাজে আসছে না।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও কাঞ্চনপুরবাসীর ভাগ্য বদলায়নি। স্থানীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম এই ইউনিয়নে পদ্মার ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগই নেননি। প্রতি বছর তীব্র ভাঙন দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দায় সারতে কিছু বালুর বস্তা ফেলে চলে যায়। কিন্তু পদ্মার তীব্র স্রোত আর ঢেউয়ের আঘাতে বালুর বস্তাগুলোও খুব বেশি সময় নদীর পাড়ে টিকে থাকে না। ফলে প্রতি বছরই পদ্মাপাড়ের মানুষজনের বাড়িঘর, গাছপালা, ফসলি সব ভেঙে চলে যায় নদীর বুকে।
এমন দুর্দশায় পদ্মা তীরবর্তী এলাকার মানুষজনের ক্ষোভের অন্ত নেই। ইউনিয়নের কোটকান্দি গ্রামের চায়ের দোকানদার হারুন মোল্লা বলেন, ‘পদ্মাপাড়েই বাড়ি। ভাঙতে ভাঙতে নদী চলে এসেছে বাড়ির একদম কাছে। যেকোনো সময় হয়তো বড় আকারে একটু ভাঙন শুরু হলেই বাড়িটাকে গিলে খাবে পদ্মা। বাড়িটুকু চলে গেলে পথে বসতে হবে। সবসময় এই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। চোখের সামনে কত বাড়িঘর চলে যেতে দেখলাম, কিন্তু ভাঙন রোধে স্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত কেউ করল না!’
ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের খুশিয়ারচর গ্রামের সাবেক মেম্বার বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ির তিন ভাগের এক ভাগ নদীতে বিলীন। যেভাবে ভাঙন দেখা দিয়েছে, যেকোনো সময় পুরো বাড়ি নদীগর্ভে চলে যাবে। আমরা যারা পদ্মাপাড়ে বসবাস করি, তাদের দিকে কেউ তাকায় না।’
কুশিয়ারচর গ্রামের বেলায়েত মেম্বার বলেন, ‘আমার ১২০ শতাংশ বাড়ি ছিল। গত কয়েক বছরে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জমি পদ্মায় ভেঙে নিয়ে গেছে। একটা পামঅয়েল গাছ ছিল। কয়েক দিন আগেই ওই গাছসহ বাড়ির কিছু অংশ ভেঙে গেছে। বাড়ির যেটুকু বাকি আছে, সেটুকুও কখন যে পদ্মা গিলে খায়, সেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়।’
একই গ্রামের কৃষক ফয়েজউদ্দীন বলেন, ‘দুইবার বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ছয়-সাত বছর হলো কুশিয়ারচরে বসবাস করছি। ভাঙনের যে অবস্থা, তাতে যেকোনো মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যাবে। ভাঙনরোধে স্থায়ী বেড়িবাঁধ চাই আমরা।’
মালুচি এলাকার আখিজদ্দীন বলেন, ‘কুশিয়ারচর ও আমার বাড়ির এখানে মালুচিতে বস্তা না ফেললে আমার বাড়ি ও কুশিয়ারচরের কয়েকটি বাড়ি যেকোনো সময় ভেঙে যাবে।’
এদিকে সম্প্রতি কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পদ্মা নদী তীরবর্তী মালুচি ও কুশিয়ারচরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে নতুন করে নদী ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছে পদ্মাপাড়ের হাজারও মানুষ। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে কুশিয়ারচর গায়েনবাড়ি মসজিদ, হোসেন শাহের মাজার, মালুচি মসজিদ ও অর্ধশতাধিক বাড়িঘর।
ভাঙনকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় নদী তীরবর্তী কৃষিজমির অনেক জায়গায় ফাটল ধরেছে। নদীর তীরে পানির গভীরতা বেশি হওয়ায় পানি বাড়তে থাকলে তীব্র স্রোতও তৈরি হয়।
কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গাজী বনি ইসলাম রূপক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েক বছরে পদ্মার ভাঙনে ১৩টি মৌজার ১২টি মৌজাই পদ্মায় ভেঙে গেছে। এখন শুধু গৌড়বোরদিয়া মৌজা অবশিষ্ট। গত দুই-তিন বছরে কোর্টকান্দি, মুহম্মদপুর ও বৌদ্ধকান্দিতে পদ্মার ভাঙনে শত শত বিঘা জমি ও বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। পানি বাড়লে স্রোতের কয়েকদিন আগে বিল্লাল মেম্বারের বাড়ির সামনে জিও ব্যাগ ধসে গেছে। এখনো ৫০০ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ পড়েনি। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করা হয়েছে।’
ইউপি চেয়ারম্যান রূপক তিনি আরও বলেন আমাদের এলাকার সাবেক দুই সংসদ সদস্যের কাছে ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানানো হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। কাঞ্চনপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকাকে পদ্মার ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে স্থায়ী বেড়িবাঁদের বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে হরিরামপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন, কাঞ্চনপুরের কুশিয়ারচর ও মালুচি এলাকা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘হরিরামপুরের চরাঞ্চলে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে কাজ শুরু হয়েছে। কুশিয়ারচর ও মালুচি এলাকায়ও দ্রুত সময়ের মধ্যে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/টিআর
সারাবাংলা/টিআর