ক্যাম্পাসে ‘নিশ্চিহ্ন’ ছাত্রলীগ, ফেরাতে নারাজ ছাত্র সংগঠনগুলো
৮ অক্টোবর ২০২৪ ১১:৩৩
মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল বদলে গেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার এই ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসেও একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ছাত্রলীগের। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মুখে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো ক্যাম্পাসের রাজনীতিতেও ছাত্রলীগ যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও একই দশা ছাত্রলীগের। মধুর ক্যানটিন বা টিএসসির মতো জায়গাগুলো পুরোটাই দখলে থাকত যে সংগঠনটির, সেখানে গোটা ক্যাম্পাসেই তাদের যেন কোনো অস্তিত্ব নেই। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, শ্রেণিকক্ষে বা হলে যাওয়া নিয়েও তাদের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক কাজ করছে।
এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও সে ইচ্ছা বাস্তবায়ন কবে হতে পারে, তা নিয়ে কিছুই বলতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। তাদের অনেকেই বলছেন, নিজেরা নানা পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ করলেও সংগঠনটির বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত ছিলেন না। কেবল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে আজ তাদেরও শাস্তি পেতে হচ্ছে।
এদিকে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে। তাদের ভাষ্য, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার ছিল। ক্যাম্পাসেও তারা একই কায়দায় অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে, ‘গণহত্যার দোসর’ হয়েছে। ফলে ছাত্রলীগের ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার অধিকার এখন নেই।
গত ১৭ জুলাইয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়েছিল ছাত্রলীগ। পরে তারা আর ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেনি। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত দুয়েকজন আরও কিছুদিন ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছেন, তবে তাদেরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে থাকতে হয়েছে। এখন আর ছাত্রলীগের পদধারী কোনো নেতাকর্মী হল বা ঢাবি ক্যাম্পাসে ফিরতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ছাত্রলীগ নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের পদ থাকায় ক্যাম্পাস যেতে পারছি না। এমনকি ক্লাসে ফেরারও কোনো উপায় দেখছি না। বলতে গেলে ছাত্রলীগ করার দায় বহন করতে হচ্ছে আমাদের। অথচ ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা যেসব অপকর্ম-কুকর্ম করেছে, আমরা ছোট ছোট পদধারী বা ছাত্রলীগের কর্মীরা সেগুলোর কিছুর সঙ্গেই জড়িত ছিলাম না।
আসিফ নামের এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘আমার ক্যাম্পাস আমার কাছে অনিরাপদ হয়ে গেছে। এর দায় একমাত্র আওয়ামী লীগের। আমরা ছাত্রলীগ করেছি, ঠিক আছে। তবে অন্যায় করিনি। তাও সব দায়ভার আমাদের। না পারছি নিজের ক্যাম্পাসে ফিরতে, না পারছি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে। ছাত্রলীগ আমাদের জীবনে দুঃখ হয়ে ফিরে আসলো।’
ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, কোনো হলেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান নেই। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত দুয়েকজন হলে প্রবেশ করতে গেলেও মারধরের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে ১৫ জুলাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
ঢাবি ক্যাম্পাসের মতো অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশেই ছাত্রলীগের পরিস্থিতি একই। না আছে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম, না আছে শারীরিক উপস্থিতি। দুই মাস আগেও যে ছাত্র সংগঠনটির প্রতাপ ছিল সারা দেশে, আজ সেই সংগঠনটি যেন উধাও হয়ে গেছেন। এ পরিস্থিতিতে দেশের ইতিহাসের দীর্ঘ সময়ের দাপুটে ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কীভাবে রাজনীতিতে ফিরবে, কবে ফিরবে— এমন প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনেই।
ছাত্রলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে তাদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে না। সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ছাত্রলীগ কবে রাজনীতিতে ফিরতে পারে— এ নিয়ে তথ্য নেই তাদের কারও কাছে। আপাতত তারা নিজেদের জীবন নিয়েই হুমকির মধ্যে আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা সারাবাংলাকে বলেন, সরকার পতনের পর ছাত্রলীগ এক ধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে। তার মানে এই নয় যে আমরা বিলীন হয়ে গেছি। আমাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। ক্যাম্পাসে গেলেই মারধরের শিকার হতে হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমরা ক্যাম্পাস, হল কোথওই ফিরতে পারছি না। জানি না, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে কবে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও ছাত্রলীগ ঢাবি শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়াও সম্ভব হয়নি।
ছাত্রলীগকে ফেরাতে রাজি নয় কেউ
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি ও ক্যাম্পাসে ফেরার তাগিদ থাকলেও ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রলীগকে রাজনীতি করতে দিতে রাজি নয়। এমনকি কিছু শিক্ষার্থীও ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধ থাকার পক্ষে। বরং তারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন সময়ের ‘অপকর্মে’র বিচারের দাবিও তুলছেন।
জসিমউদদীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ছাত্রলীগ গত ১৫ বছর ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চালিয়েছে তা শিক্ষার্থীরা কখনো ভুলবে না। তাই আমরা চাই, ছাত্রলীগ যে কর্মকাণ্ডগুলো করে গেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
মহসিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাদেক হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যা করেছে, তাতে মামলা কিছু না। এদের নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত, যেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন প্রভু ভাবাপন্ন আচরণ করতে না পারে।
ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে একই ধরনের ভাষ্য ছাত্র সংগঠনগুলোরও। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ ১৬ বছরে ব্যাপক দখলদারিত্ব ও ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে তারা শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ পর্যন্ত করেছে এবং সেই আক্রমণ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হয়েছে। তাই তারা যেন পুনরায় ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে না পারে, সে বিষয়ে শিক্ষার্থী ও ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে সচেতন থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন ছাত্রলীগকে পুর্নবাসন করতে না পারে, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।’
ছাত্রলীগ রাজনীতিতে ফিরতে চাইলে ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলো তাদের গ্রহণ করবে কি না— এ প্রশ্নের জবাবে সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘এটা আমার সিদ্ধান্ত দিয়েও হবে না, ছাত্রলীগের নিজের সিদ্ধান্ত দিয়েও হবে না। ছাত্রলীগকে যদি শিক্ষার্থীরা চায়. তারা আসবে। তবে তারা ১৬ বছর ধরে যে অন্যায় করে গেছে, তার বিচার হতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা আছে। সেগুলো নিষ্পত্তি হওয়ার পর তারা ও শিক্ষার্থীরা চাইলে ছাত্রলীগ রাজনীতিতে ফিরতে পারে।’
জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হাতুড়ি বাহিনী ছাত্রলীগ কিন্তু শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের সব ক্যাম্পাস থেকেই এখন বিতাড়িত। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তারা গণহত্যাকারী বাহিনী হিসেবে তাদের সর্বস্তরের অসংখ্য নেতাকর্মী বিচারের আওতায় আসবে শিগগিরই। সে অবস্থায় সংগঠন হিসেবে তাদের ফিরে আসার নৈতিক ও গঠনগত শক্তি হতে আরও কতদিন লাগবে— সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে।’
গণেশ চন্দ্র আরও বলেন, ‘ছাত্রদল শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির আদর্শ অনুসরণ করে। সে আদর্শ অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা মেনে নেওয়া যায় না। তবে কোনো সংগঠনের আদর্শ ও কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কিংবা গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে থাকলে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আদর্শগত ও গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন না এনে তাদের রাজনীতি করা প্রায় অসম্ভব হবে বলেই মনে করি।
ছাত্রশিবির অবশ্য সরাসরিই ছাত্রলীগের রাজনীতির বিরোধিতা করছে। সংগঠনটির ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ বলেন, ‘যে ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে, দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের মতো দুঃসাহস দেখাতে পারে, ওই সংগঠনের ক্যাম্পাসে রাজনীতি করা তো দূরের কথা, নিজেকে এই সংগঠনের অংশ দাবি করার মতো নির্লজ্জ মনে হয় কেউ হবে না। শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করে হতাহতের ঘটনায় তাদের রাজনীতি ক্যাম্পাস থেকে কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।’
ফরহাদ আরও বলেন, ‘১৫ জুলাই ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করার পরে শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই একমাত্র ঘটনা যেখানে শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে কোনো ছাত্র সংগঠনকে সব ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছে। এর মধ্যে দিয়েই তাদের রাজনীতি নেই হয়ে যায়।’
শিবির ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদকের শেষ দাবিটি অবশ্য শতভাগ সত্য নয় বলে জানালেন ছাত্র নেতারা। তারা বলছেন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সব সংগঠন একজোট হয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাত্রশিবির ও জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র সমাজের রাজনীতি বন্ধ করে দিয়েছিল। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগসহ অন্য সংগঠনগুলো মিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাত্রশিবিরকে বিতাড়িত করেছিল।
সারাবাংলা/এআইএন/টিআর