ময়মনসিংহে নতুন প্লাবিত ৫০ গ্রাম, ভেসে গেছে ১০ হাজার পুকুরের মাছ
৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০০
ময়মনসিংহ: প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ৫০টি গ্রাম। তিন উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
বন্যা পরিস্থিতিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে জেলার মৎস্য খাত। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, ১০ হাজার ৭৫১টি পুকুর ও খামারের এক হাজার ৭৪২ মেট্রিক টন মাছ এরই মধ্যে ভেসে গেছে। সাত হাজার মৎস্য চাষির ক্ষতির পরিমাণ ৫৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুর্নবাসন কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন জানান, বন্যাকবলিত উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তিন উপজেলায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬৩ মেট্রিক টন চাল ও নগদ সাত লাখ টাকা। বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণের পাশাপাশি রান্না করা খাবারও বিতরণ করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, ধোবাউড়া উপজেলার ঘোষগাঁও, দক্ষিণ মাইজপাড়া, গামারীতলা, বাঘবেড়সহ সাতটি ইউনিয়নে পানিবন্দি কয়েক হাজার মানুষ। পাহাড়ি ঢলের তীব্র স্রোতে ঘোষগাঁও ইউনিয়নের জিগাতলা গ্রামে নেতাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জমির ফসল ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পানিবন্দি মানুষ গৃহপালিত পশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
উপজেলার উত্তরাঞ্চলে পানি কিছুটা কমলেও দক্ষিণাঞ্চলে পানি বেড়েছে। ২৬টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চার দিনের টানা বর্ষণে দুর্ভোগে দিশেহারা মানুষ।
ধোবাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ওয়ারিছ মেম্বার বলেন, পানিবন্দি মানুষ চিড়া-মুড়ি খেয়ে দিনযাপন করছেন। তারাকান্দি গ্রামের কুলসুম আক্তার বলেন, ‘চার দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় আছি। বাড়ির উঠানেও হাঁটুপানি। রান্না করা যাচ্ছে না। হাঁস-মুরগি মরে গেছে।’
মান্দালিয়া গ্রামের রামিজা খাতুন জানান, রান্নার চুলা ডুবে যাওয়ায় রান্না করতে পারছেন না। চার দিন ধরে শুকনো খাবার খেয়ে আছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সরওয়ার তুষার জানান, আট হাজার ৪২০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ও চার হাজার ৮১০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে উপজেলা প্রকৌশলী আবু বকর ছিদ্দিক জানান, ১২৭ কিলোমিটার রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
ধোবাউড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন বলেন, নতুন করে উপজেলার দুটি ইউনিয়নের ২৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উজানের পানি কিছুটা কমছে। দুয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।
এদিকে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় হালুয়াঘাট উপজেলায় পাঁচটি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উজানের পানি কমে যাওয়ায় ভূবনকুড়া, জুগলী, গাজিরভিটা, সদর ও পৌরসভার পানি নেমে গেছে।
হালুয়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদুল আহমেদ বলেন, উপজেলার উজানের দিকে প্লাবিত হওয়া গ্রামের পানি নামতে শুরু করেছে। নড়াইল, কৈচাপুর, ধুরাইল ও আমতৈল ইউনিয়নের পানি ফুলপুর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
এর মধ্যে সদর দফতর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের তত্ত্বাবধানে ৪০৩ ব্যাটেল গ্রুপের অধীন ইউনিট ২১ ইবি হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে বন্যার্তদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণও বিতরণ করেছে। সেনা সূত্র জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
বন্যাকবলিত আরেক উপজেলা ফুলপুরে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার ছনধরা, সিংহেশ্বর ও ফুলপুর ইউনিয়নের ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ১০টি গ্রাম। এ ছাড়া ফুলপুর সদর, রূপসী, বালিয়া, বওলা, ভাইটকান্দি ও রামভদ্রপুর ইউনিয়নের অনেক জমির আমন ফসল ও সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ জানান, এক হাজার ৬২০ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান সম্পূর্ণ ও দুই হাজার ৪৪০ হেক্টর জমির আমন ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭৫ হেক্টর জমি সবজি ফসল সম্পূর্ণ ও ৭০ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম আরিফুল ইসলাম জানান, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে পাশের জেলা শেরপুরে চার দিনের বন্যায় এখন পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শেরপুর কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, পৌনে দুই লাখ কৃষকের প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তিন হাজার মাছের ঘের ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার। জেলার ২৪২টি প্রাথমিক ও ৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় পানি কমলেও এখনো নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ঘরে ঘরে পানি রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও বিভিন্ন দফতর। তবে সব জায়গায় নৌকা না থাকায় ত্রাণ সরবরাহে কিছুটা দেরিও হচ্ছে।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, জেলার প্রায় সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। পানি কমতে শুরু করেছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ায় বন্যার ক্ষত স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
সারাবাংলা/টিআর