ঢাকা: অধ্যাপক ড. মো. মহব্বত আলী। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার (পার্ট টাইম) হিসেবে কর্মরত। কিন্তু তাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে ঢাবির এআইএস বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে অবসর নিতে হয়েছে। আর এই অবসর যেতে তাকে ঢাবির বিজনেস স্টাডিজের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত চাপ প্রয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাবি উপাচার্য বরাবর চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে এক আবেদনে মহব্বত আলী এমন অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সিনিয়র লেকচারার (পার্ট টাইম) পদে যোগ দিতে ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘অসাধারণ ছুটি’র জন্য আবেদন করেন অধ্যাপক মহব্বত আলী। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর সিঅ্যান্ডডি কমিটি তাকে বিনা বেতনে এক বছরের ছুটি দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার বরাবর সুপারিশ করে। কিন্তু এর দুই দিন পর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করেন মহব্বত আলী। সেদিনই সিঅ্যান্ডডি কমিটি তার অবসর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। পরে ২৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তার অবসর অনুমোদন হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট নথি বলছে, বিভাগীয় সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি (সিঅ্যান্ডডি) এক বছরের জন্য তার ছুটি মঞ্জুরের সুপারিশও করেছিল। কিন্তু এই সুপারিশের দু’দিনের মাথায় রহস্যজনকভাবে স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করেন এই অধ্যাপক। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য বরাবর এক আবেদনে ড. মো. মহব্বত আলী জানিয়েছেন, বিভাগের পক্ষ থেকে ছুটির সুপারিশ এবং অর্জিত ও অসাধারণ ছুটি পাওনা থাকার পরও বিজনেস স্টাডিজের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতের ‘চাপে’ অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। আবেদনে তিনি চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিও জানিয়েছেন।
কিন্তু কী এমন ঘটেছিল যে, অধ্যাপক মহব্বত আলী স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য হলেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠি এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ সূত্রে জানা গেছে, অনুষদের তৎকালীন ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে প্রচ্ছন্ন হুমকির মাধ্যমে তাকে অবসর নিতে বাধ্য করেছেন।
ভিসির কাছে পাঠানো চিঠিতে অধ্যাপক ড. মো. মহব্বত আলী বলেছেন, ‘প্রয়োজনীয় ছুটি পাওনা থাকায় ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিভাগের সিঅ্যান্ডডি কমিটির সভায় আমার ছুটি মঞ্জুরের সুপারিশ করে। বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডিন অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রার বরাবর আমার আবেদনপত্রটি পাঠায়। আবেদনটি যাতে ডিন অফিস হয়ে রেজিস্টারের মাধ্যমে পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় (২৯ ডিসেম্বর ২০১৯) নথিভুক্ত হতে পারে সেজন্য আমি হাতে হাতে আবেদনপত্রটি নিয়ে ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং বিস্তারিত বর্ণনা করি। সবকিছু শুনে তিনি আমাকে ছুটির আবেদনের পরিবর্তে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য উপদেশ দেন।’
অধ্যাপক মহব্বত আলীর অভিযোগ, ‘শিবলী রুবায়াতুল বলেন, আপনার তো ছুটি হবে না। ছুটি যদি হয়েও যায় এক বছর পরে এসে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে পারবেন না। তখন ফাইলের পেছনে তদবির করতে করতে জুতার তলা খুলে যাবে, তবুও আপনার ফাইল নড়বে না। তখন চাইলে চাকরি ছাড়তেও পারবেন না। আপনি তো দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা জানেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বুঝেন। তাই চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়াই আপনার জন্য ভালো। আর অবসরে যাওয়ার আবেদন করলে আপনি যাতে রিটায়ারমেন্টের টাকা-পয়সা দ্রুত পান সেই ব্যবস্থা করে দেবো।’
অধ্যাপক মহব্বত বলেন, ‘এসব কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। এমনকি কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। ২৪ বছর সুনামের সঙ্গে চাকরি করা একজন অধ্যাপককে আরেকজন অধ্যাপক কীভাবে এরকম অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য কথা বলতে পারে? এটাতো হুমকি দেওয়া ও ভয় দেখানো ছাড়া কিছু না। তবুও আমি তাকে আমার আবেদন ফরোয়ার্ড করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চলে আসি। ডিসেম্বর মাসের সিন্ডিকেট মিস করলে আমি অস্ট্রেলিয়ায় কাজে যোগদানের তারিখ মিস করব। কারণ, আমার হাতে সময় ছিল মাত্র দু’দিন।’
তিনি বলেন, “আমার এক বছরের মতো অর্জিত ছুটি এবং এক বছর দুই মাসের মতো অসাধারণ ছুটি অব্যবহৃত ছিল। এই অবস্থায় অবসরে গেলে পূর্ণ পেনশন সুবিধা পাওয়া যাবে না জেনেও আমি ডিনের চাওয়া মোতাবেক ‘আর্লি রিটায়ারমেন্টের’ আবেদন করি। অত্যন্ত দ্রুততায় সব পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে ২৯ ডিসেম্বর সিন্ডিকেট মিটিংয়ে আমার অবসর অনুমোদন হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, ‘আমি অধ্যাপক শিবলীর ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতাম। তিনি যা করতে চান, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাইরে কিছু হতে পারতো না। চিন্তা করি, যদি আমি ডিনের পরামর্শ মতে চাকরি না ছাড়ি এবং আমার ছুটির আবেদন নাকচ হয়ে যায়, অথবা সিন্ডিকেটের আলোচ্যসূচিতে আমার আবেদনটি না থাকে তাহলে আমি একদিকে অস্ট্রেলিয়ার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব, অন্যদিকে ফ্যাকাল্টিতেও একরকম হুমকি নিয়ে চলতে হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বক্তব্য জানতে ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, তিনি ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। যদিও আরেক সূত্র বলছে, তিনি বর্তমানে দেশে আছেন। এ বিষয়ে জানতে ব্যবসায়ী শিক্ষা অনুষদের বর্তমান ডিন ড. মাহমুদ ওসমান ইমামকে একাধিকবার ফোন করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হাতে এরকম বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। এগুলো আইনি জায়গা থেকে আমরা দেখছি এবং আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করছি। কোনো শিক্ষক যদি রাজনৈতিক কারণে কিংবা অর্থনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার হন তাহলে তিনি যেই মতাদর্শেরই হোক না কেন আইন উপদেষ্টার মতামত অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কেইস টু কেইস দেখছি। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে যেসব শিক্ষক বাজেভাবে ট্রিটেট হয়েছেন কিংবা বঞ্চিত হয়েছেন, তারা যাতে নায্য অধিকার পান আইন উপদেষ্টার মতামত নিয়ে সেভাবে আমরা কাজ করব।’
উল্লেখ্য, অসাধারণ ছুটি নেওয়ার বিধান হলো- কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে চাইলে কিংবা অসাধারণ ছুটি দরকার হলে তাকে বিভাগের চেয়ারম্যানকে মাধ্যম করে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করতে হয়। বিভাগের সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি (সিঅ্যান্ডডি) সেটা সুপারিশ করলে সিন্ডিকেটে যায়। সিন্ডিকেট থেকেই ছুটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।’