দেবী দুর্গার মর্ত্যে ‘যাতায়াতের’ বাহনের তাৎপর্য কী?
৯ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৪১
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে কিছুটা হলেও কাটছে অস্থির সময়। এর মধ্যেই হাজির শারদীয় দুর্গোৎসব। মর্ত্যে এসেছেন দেবী দুর্গা। আর দেবীর আগমন ঘিরেই অনেকের মনে প্রশ্ন— দেবী এবার কৈলাশ থেকে মর্ত্যে আসছেন কীসে চেপে? বিসর্জনের পর মর্ত্য থেকেই বা কৈলাশে যাবেন কীসে চড়ে?
এমন প্রশ্নের নেপথ্যে রয়েছে হিন্দুশাস্ত্র। কারণ শাস্ত্র বলছে, দেবীর কৈলাশ থেকে দেবীর মর্ত্যে যাতায়াতের বাহনের মধ্যেও শুভ ও অশুভ ঘটনাচক্রের যোগসূত্র রয়েছে। দেবী দুর্গা কোন বাহনে করে মর্ত্যে আসবেন বা কোন বাহনে করে মর্ত্য থেকে প্রস্থান করবেন, তার ওপর নির্ভর করে সারা বছর কেমন কাটবে।
দেবী দুর্গা ও তার চার পুত্র-কন্যার প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব বাহন। দেবী দুর্গার সিংহ, স্বরস্বতীর রাজহাঁস, লক্ষ্মীর পেঁচা, কার্তিকের ময়ূর ও গণেশের ইঁদুর— সাধারণ সময়ে এই বাহনগুলো করেই দেবী দুর্গা ও তার পুত্র-কন্যারা যাতায়াত করে থাকেন। তবে ভক্তদের আহ্বানে দেবী দুর্গা যখন শারদীয় দুর্গোৎসব তথা দুর্গাপূজার সময় মর্ত্যে আসেন, তখন প্রতি বছরই তার আসা-যাওয়ার পথে থাকে ভিন্ন ভিন্ন বাহন। পঞ্জিকাগুলোতে দেবীর আগমন ও প্রস্থানের বাহনের কথা আলাদা করেই উল্লেখ থাকে।
এ বছর গতকাল মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) পঞ্চমীর সন্ধ্যায় হয়ে গেছে দেবীর বোধন। বোধন শেষে বুধবার (৯ অক্টোবর) ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। পঞ্জিকামতে, এ বছর দেবী মর্ত্যে এসেছেন দোলায় চড়ে, কৈলাশে ফিরবেন ঘোটকে চেপে।
যেভাবে নির্ধারণ দেবী দুর্গার বাহন
শাস্ত্রমতে পূজার সপ্তমীতে দেবীর আগমন হয়, আর গমন হয় দশমীতে। এই দুই দিন সপ্তাহের কোন কোন বারে পড়ছে, তার ওপরেই নির্ভর করেই স্থির হয় দেবীর আসা-যাওয়ার বাহন। শাস্ত্র বলছে—
রবিশশী গজারূঢ়া,
শনিমঙ্গলে চ ঘোটকে।
গুরৌশুক্রে চ দোলায়াং,
নৌকায়াং বুধবাসরে।
এই শ্লোক অনুযায়ীই দেবী দুর্গার আগমন ও গমনের বাহন নির্ধারিত হয়। হিসাবটা দাঁড়ায় এমন—
- সপ্তমী শনিবার বা মঙ্গলবার হলে দেবীর বাহন হবে ঘোটক বা ঘোড়া;
- সপ্তমী রোববার বা সোমবার হলে দেবীর বাহন হবে গজ বা হাতি;
- সপ্তমী বুধবার হলে দেবীর বাহন হবে নৌকা; এবং
- সপ্তমী বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর বাহন হবে দোলা বা পালকি।
এদিকে সপ্তমীর দিন দিয়ে যেভাবে দেবীর আগমনের বাহন নির্ধারিত হয়, তেমনি দেবীর গমন তথা প্রস্থানের বাহন নির্ধারিত হয় দশমীর দিনের হিসাবে। শাস্ত্র বলছে—
- বিজয়া দশমী শনিবার বা মঙ্গলবার হলে দেবীর বাহন হবে ঘোটক বা ঘোড়া;
- বিজয়া দশমী রোববার বা সোমবার হলে দেবীর বাহন হবে গজ বা হাতি;
- বিজয়া দশমী বুধবার হলে দেবীর বাহন হবে নৌকা; আর
- বিজয়া দশমী বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে দেবীর বাহন হবে দোলা বা পালকি।
শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গার যাতায়াতের বাহনের তাৎপর্য
শাস্ত্র বলছে—
গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা।
ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে।
দোলায়াং মড়কং ভবেৎ।
নৌকায়াং জলবৃদ্ধি শস্যবৃদ্ধিশ্চ।
অর্থাৎ, হিন্দু শাস্ত্রমতে, দেবীর আগমন ও গমন একই বাহনে সাধারণত হয় না। কোনো বছর তেমনটি হলে তা মহাবিপর্যয় ও খুবই অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। এ ছাড়া দেবী দুর্গার বাহন ঘোটক বা ঘোড়া, গজ বা হাতি, নৌকা এবং কিংবা দোলা বা পালকির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য।
- গজ বা হাতি— হিন্দু শাস্ত্রে দেবী দুর্গার উৎকৃষ্টতম বাহন হিসেবে বিবেচিত গজ বা হাতি। ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’— যদি মা দুর্গা হাতিতে চড়ে আগমন বা গমন হয়, এর অর্থ কোনো মহামারি, অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি ছাড়াই মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে। এ বাহনে আগমন বা গমনের মাধ্যমে ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ারও ইঙ্গিত দেন দেবী।
- ঘোটক বা ঘোড়া— যদি দেবী দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে আসেন বা বিদায় নেন, তবে তার ফল ‘ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’ অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে অস্থিরতার ইঙ্গিত। এ বাহনের মাধ্যমে দেবী ভক্তদের রাজায়-রাজায় বা রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ সূচনার ইঙ্গিত দেন, যার ফলে সমাজে দেখা দেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে ধ্বংস ও অস্থিরতা।
- দোলা বা পালকি— ‘দোলায়াং মড়কং ভবেৎ’, অর্থাৎ দেবী দুর্গা দোলায় বা পালকিতে করে আসার অর্থ পৃথিবীতে মহামারি বা মড়ক, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ, অতিমৃত্যুর শঙ্কা। বছরের এ শঙ্কা ভক্তদের আগাম জানিয়ে দিতেই ধরাধামে নেমে আসতে কিংবা কৈলাশে ফিরে যেতে এ বাহনে চড়েন দেবী দুর্গা।
- নৌকা — ‘নৌকায়াং জলবৃদ্ধি শস্যবৃদ্ধিশ্চ’, অর্থাৎ দেবী দুর্গার আগমন বা গমন নৌকা হলে এর অর্থ পৃথিবীতে প্রবল বন্যা ও খরার শঙ্কা। একই সঙ্গে সম্ভাবনা পৃথিবী শস্য-শ্যামলে ভরে ওঠারও।
এ বছর দেবী দুর্গার বাহন
সনাতন ধর্মাবলম্বী ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার এ বছরের যাত্রা শুরু অন্যবারের তুলনায় কিছুটা ভিন্নভাবে। তিথি গণনার পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবারের দুর্গাৎসবের দিনক্ষণে বড় ধরনের পরিবর্তন রয়েছে। সে কারণেই দেবী দুর্গার আগমন ও গমন দিচ্ছে দুর্যোগ-দুর্ভোগের ইঙ্গিত!
হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, ভক্তের ডাকে প্রতিবছর মর্ত্যলোকে আসতে ও নিজ বাসস্থান কৈলাসে ফিরে যেতে শক্তির দেবী দুর্গার রয়েছে বিশেষ বাহন। চলতি বছরের তিথি অনুযায়ী, এবারের শারদীয় দুর্গা পূজার মূল পর্ব সপ্তমী পড়েছে বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর)। শাস্ত্র অনুযায়ী তাই এবার মা দুর্গা আসছেন দোলা বা পালকিতে চড়ে। একইভাবে বিজয়া দশমী শনিবার (১২ অক্টোবর) হওয়ায় ঘোটক বা ঘোড়ায় চেপে দেবী দুর্গা কৈলাসে ফিরবেন।
এবার দেবীর বোধন তথা মহাপঞ্চমী পড়েছে মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায়। বুধবার (৯ অক্টোবর) মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) মহাসপ্তমীর পর মহাঅষ্টমী ও মহানবমী পড়েছে একই দিনে— শুক্রবার (১১ অক্টোবর)।
তিথি অনুযায়ী এ বছর বিজয়া দশমী শনিবার (১২ অক্টোবর)। কারণ এর পরদিন রোববার (১৩ অক্টোবর) একাদশীর লগ্ন রয়েছে। শাস্ত্র অনুযায়ী, ওই মুহূর্তে দেবীর প্রতিরূপ বিসর্জন সম্ভব নয়।
অর্থাৎ এবারের দুর্গা পূজায় মা দুর্গার আসা ও যাওয়া— দুটোই দিচ্ছে বিপদের সংকেত। আগমন দোলায় বা পালকিতে হওয়ায় দেবী মর্ত্যবাসীদের আগাম জানান দিচ্ছেন— এ বছর মহামারি বা মড়ক, ভূমিকম্প, খরা, যুদ্ধ, অতিমৃত্যুর মতো দুর্যোগের শঙ্কা রয়েছে। একইভাবে গমন ঘোড়া বা ঘোটক হওয়ার ফলাফল ছত্রভঙ্গ— এর মাধ্যমে ভক্তদের রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন দেবী দুর্গা। আগামী এক বছর তাই পৃথিবীতে অশুভ প্রভাব থাকবে বলে আশঙ্কা শাস্ত্রজ্ঞদের।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বলেন, এ বছর দেবী দুর্গার আগমন ও গমন দুটোতেই রয়েছে অশুভ ইঙ্গিত। দেবীর বাহন দোলা বা পালকি মড়কের ইঙ্গিত। খাদ্যশস্যে পোকামাকড়ের আক্রমণ হবে। রোগব্যাধি বাড়বে। আবার দেবীর বাহন ঘোটক বা ঘোড়ার অর্থ ছত্রভঙ্গ, যা সামাজিক-রাজনৈতিক এলোমেলো অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরির ইঙ্গিত দেয়।
পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী আরও বলেন, যত অশুভ ইঙ্গিতই থাকুক না কেন, আমরা প্রার্থনা করব— বিশ্ব জুড়ে যেন শান্তি বজায় থাকে। দেবীর ভক্তরাও বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায় আরাধনায় রত হবেন। ভক্তের আরাধনায় দেবীর মন তুষ্ট হলে দেবী হয়তো সবার জীবনে শান্তির সুবাস ছড়িয়ে দিতে পারেন।
সপ্তমী থেকে দশমী— কোন পূজা কোন সময়ে
মহালয়া আর মহাপঞ্চমীর পর মহাষষ্ঠীতেও চণ্ডীপাঠ ও চণ্ডীপূজার মাধ্যমে এ বছরের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এই আয়োজন শেষ হবে বিজয়া দশমীতে মহা-আরতির মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে। পঞ্জিকামতে দুর্গাপূজার বাকি দিনগুলোর সময়সূচি দেখে নেওয়া যাক একনজরে—
মহাসপ্তমী
১০ অক্টোবর (২৩ আশ্বিন), বৃহস্পতিবার। এ দিন সকালে নবপত্রিকা স্থাপন করা হবে। ‘নবপত্রিকা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ৯টি গাছের পাতা। কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধান— এই ৯টি উদ্ভিদকে পাতাসহ একটি কলাগাছের সঙ্গে একত্র করা হয়।
পরে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম ‘কলাবউ’।
নবপত্রিকার ৯টি উদ্ভিদ প্রকৃতপক্ষে দেবী দুর্গার ৯টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে বিবেচনা করা হয়। এই ৯ দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’ নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমোঃ’ মন্ত্রে পূজিত হন।
নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। দুর্গাপ্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন উপচারে দেবীকে স্নান করানো হয়।
মহাষ্টমী
১১ অক্টোবর (২৪ আশ্বিন), শুক্রবার। অষ্টমী পূজার মূল আকর্ষণ কুমারী পূজা। এদিন ফুল, জল, বেলপাতা, ধূপ-দীপসহ ষোড়শ উপচারে কুমারীরূপে দেবী দুর্গারই আরাধনা করা হয়। ঢাকায় সবচেয়ে বড় পরিসরে কুমারী পূজা হয় রামকৃষ্ণ মিশনে।
মহানবমী
১২ অক্টোবর (২৫ আশ্বিন), শনিবার। এ দিন সকালে তর্পণে দুর্গার মহাস্নান হবে, ষোড়শ উপচারে পূজা করা হবে। পুষ্প, অর্ঘ্য নিবেদন শেষে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন ভক্তরা। কোনো কোনো মণ্ডপে নবমীতে যজ্ঞের আয়োজন হয়। মহানবমীতে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে ভক্তদের হৃদয়।
মহাদশমী
১২ ও ১৩ অক্টোবর (২৫-২৬ আশ্বিন), শনিবার ও রোববার। কারণ পঞ্জিকামতে, এ বছর দশমী শনিবার রাতে শুরু হয়ে রোববার সকাল পর্যন্ত চলবে। আর তাই নবমী অর্থাৎ শনিবার (১২ অক্টোবর) রাত থেকে রোববার (১৩ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত পড়েছে বিজয়া দশমী।
তবে তিথি অনুযায়ী, বিজয়া দশমীর বিসর্জন হতে পারে শনিবার (১২ অক্টোবর)। কারণ পরদিন রোববার (১৩ অক্টোবর) একাদশীর লগ্ন রয়েছে। শাস্ত্র অনুযায়ী, ওই মুহূর্তে দেবীর প্রতিরূপ বিসর্জন সম্ভব নয়।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
দুর্গা পূজা দুর্গার বাহন দেবী দুর্গা দেবী দুর্গার বাহন বিজয়া দশমী মহানবমী মহাষষ্ঠী মহাসপ্তমী মা দুর্গা শারদীয় দুর্গোৎসব