মহাসপ্তমী আজ, ভোরে কলা বৌ স্নান
১০ অক্টোবর ২০২৪ ০০:০৫
ঢাকা: বোধন শেষে ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আনন্দময়ী, বিপৎনাশিনী দেবী দুর্গার আগমনে মুখরিত পূজা মণ্ডপ। ধূপ-আগরবাতির গন্ধে আর শঙ্খ-ঘণ্টা-কাঁসরের সঙ্গে ঢাকের শব্দের সঙ্গে ভক্তদের আরাধনায় মহাষষ্ঠীতে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
মহাষষ্ঠীর লগ্ন পেরিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের মহা সপ্তমী বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর)। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার সূচি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে নবপত্রিকা প্রবেশ ও সপ্তমীর পূজা শুরু হবে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা সার্বজনীন পূজার পুরোহিত পন্ডিত শ্রী অরভিল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ৩ মিনিটে সপ্তমী পূজা শুরু করব। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে নবপত্রিকা স্নান হবে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে নবপত্রিকা প্রবেশ হবে। এরপর সকাল ৯টায় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হবে ভক্তদের।
শাস্ত্রমতে, এ দিন প্রতিটি পূজামণ্ডপে ধূপধুনো, বেল-তুলসী, আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমাল্য, চন্দনসহ ১৬টি উপাচার দিয়ে দেবী দুর্গাকে পূজা করা হবে। ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে।
মহাসপ্তমীর সকালে সর্বপ্রথম চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, মহাসপ্তমীতে ভক্তদের কল্যাণ ও শান্তির আশীর্বাদ নিয়ে হিমালয় নন্দিনী দেবী দুর্গা পূজার পিঁড়িতে বসবেন।
দেবী দুর্গার নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন করা হবে। এই নবপত্রিকা প্রবেশের আরেকটি নাম হলো কলা বৌ স্নান। এরপর সপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমীর পূজা হবে। দেহ শুদ্ধি, অঙ্গ শুদ্ধি সেরে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। ঢাকঢোল, শঙ্খ ধ্বনি-উলু ধ্বনি আর কাঁসরসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যবাজনা বেজে উঠবে। এরপর প্রতিমার সামনে পূজা শেষে দেওয়া হবে অঞ্জলি।
নবপত্রিকা কী?
দুর্গাপূজার সময় পূজা মণ্ডপে গণেশের পাশে লাল পাড় শাড়িতে ঘোমটা ঢাকা একটি কলা গাছ দেখা যায়। একেই বলা হয় ‘নবপত্রিকা’। এটি মা দুর্গা, অর্থাৎ গণেশের জননী।
শুদ্ধ ভাষায়, নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ৯টি গাছের পাতা। বাস্তবে এই নবপত্রিকা ৯টি পাতা নয়, প্রকৃতপক্ষে ৯টি গাছ— কলাগাছ, কচু, বেল, হরিদ্রা (হলুদ), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান জয়ন্তী ও ধান গাছ।
শাস্ত্রে কথিত, এই নবপত্রিকার ৯টি গাছ দেবী দুর্গার ৯টি বিশেষ রূপের প্রতীকস্বরূপ। কলা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা, হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা, জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্ত্তিকী, বিল্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা, দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা, মান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুন্ডা ও ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী। তার সবাই নবদুর্গা রূপে পূজিত হন।
কলাগাছ একেবারে মূল থেকে উৎপাটিত করে তা বেঁধে দেওয়া হয় এবং গণেশের ডান পাশেই বসানো হয় এই নবপত্রিকাকে। একেই লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা ঢাকা বউয়ের রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। দেবী দুর্গার ছেলে-মেয়ে ও মহিষাসুরের সঙ্গে পূজা পায় এই নবপত্রিকা।
কলা বৌ স্নান কী?
কলা বউয়ের স্নান দুর্গাপূজার এক বিশেষ অঙ্গস্বরূপ রীতি। দেবীপক্ষের সপ্তমীর দিন সকালে কোনো নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নবপত্রিকাকে মহাস্নান করাতে। এ সময় বাজতে থাকে ঢাক। সেখানেই শাস্ত্রবিধি মেনে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরানো হয় নবপত্রিকাকে। ফিরিয়ে নেওয়া হয় পূজা মণ্ডপে। সেখানে নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়।
এই নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দেবীকে মহাস্নান করানো হয় দর্পণে বা আয়নায়। এরপর থেকে বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমা দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। এই নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়।
মহাস্নান কী?
শুধুমাত্র মহাসপ্তমীই নয়, মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দেবী দুর্গার প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে সেখানে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মহাস্নান করানো হয়।
এই মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলে দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানোর রীতি আছে।
বলা হয়ে থাকে, এই সব রীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণিজসম্পদ, ভূমিসম্পদ ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়।
নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটিয়ে তোলা এই মহাস্নানের উদ্দেশ্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা প্রেরণ করা হয়। এককথায়, সার্বিকভাবে সমাজ কল্যাণের চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।
চলিত ভাষায় কলা বৌ স্নান নামের রীতিই শুদ্ধ ভাষায় নবপত্রিকা স্থাপন বলেও বলা হয়ে থাকে। মহাসপ্তমী পূজা উপলক্ষে প্রসাদ বিতরণ ছাড়াও সন্ধ্যায় বিভিন্ন পূজামণ্ডপে ভক্তিমূলক সংগীত, রামায়ণ পালা, আরতিসহ নানা রকমের অনুষ্ঠান হবে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর