বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন পিছু ছাড়ছে না পরিসংখ্যান ব্যুরোর
১৩ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:২৫
ঢাকা: বাংলাদেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)’। সংস্থাটি দেশের জনমিতি, স্বাস্থ্য, শিল্প ও শ্রম, জাতীয় হিসাব, মূল্য ও মজুরি, শিল্প উৎপাদন ও মূল্য সূচক, দারিদ্র্য, পরিবেশগত, জেন্ডার এবং কৃষিবিষয়ক পরিসংখ্যান সংগ্রহ এবং তথ্য পর্যালোচনা করে থাকে। সেইসঙ্গে সরকারের সবধরনের শুমারি ও জরিপ কার্যক্রম চালায় এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকের তথ্য দিয়ে থাকে।
কিন্তু বিবিএস’র প্রকাশিত তথ্য নিয়ে প্রশ্ন যেন পিছুই ছাড়ছে না। নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে ব্যবহারকারীও জানতে চায় এসব তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু। যদিও সরকারি এই সংস্থাটির দাবি, তাদের সক্ষমতা ও জরিপের মধ্যে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু অনেক জায়গায় এখনো পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারেনি বিবিএস। এমনকি তাদের নিজেদের সম্পর্কে করা জরিপেও উঠে এসেছে সেই চিত্র।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনো বিবিএস’র দক্ষতা ঘাটতি রয়েছে। ফলে বিভিন্ন সময় তাদের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে আগের তুলনায় জনবল ও সক্ষমতা বেড়েছে। সেইসঙ্গে কাজের ভেরিয়েশনও এসেছে অনেক। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই পরিসংখ্যানের তথ্য নিয়ে কথা হয়। আফ্রিকার দেশগুলোতে আরও খারাপ অবস্থা। সেই তুলনায় বাংলাদেশ ভালো আছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আগে মন্ত্রীর অনুমোদন লাগতো। এখন আমি বলে দিয়েছি, আমার কাছে আসতে হবে না। স্বাধীনভাবে মাঠ পর্যায় থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাই প্রকাশ করবে বিবিএস।’
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৬ জুন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রশ্ন তোলেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য নিয়ে। শুধু তাই নয়, কৃষিমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়েছিলেন বিবিএস’র কর্মকর্তারাও। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ওই বছরের বোরো মৌসুমে উৎপাদনের ভুল তথ্য দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সচিবালয়ে কৃষিতথ্য পরিবেশন নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে এক সমন্বয় সভায় মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ওই সময় মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আপনাদের ভুল তথ্যের কারণে আমাদের সব চেষ্টা, পরিকল্পনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। পরিসংখ্যানের দেওয়া তথ্য দেখে মনে হয়- সার, ডিজেল ও বিদ্যুতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি কৃষকদের কোনো কাজেই আসেনি।’
বিবিএসের বিরুদ্ধে মনগড়া প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগ তুলে মতিয়া বলেছিলেন, ‘যারা কৃষিতে প্রণোদনা দেওয়ার বিরোধী তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই বিবিএস এমন তথ্য দিয়েছে।’ ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য বিবিএসকে গণমাধ্যমসহ জাতির কাছে ক্ষমা চাইতেও বলেন তিনি।
সদ্য পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানও বিভিন্ন সময় বিবিএস’র তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিবিএস যেসব জরিপ করছে সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সংস্থাটির উচিত তথ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা। কেননা জনগণের করের টাকা অপচয় করে যদি সঠিক তথ্য না আসে তাহলে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে না।’
বিবিএস’র তথ্যকে নিভর্রযোগ্য মনে করেন না এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যবহারকারী। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে তাদের অবিশ্বাস বেশি। প্রশ্ন আছে বিবিএস’র অন্য সব তথ্য নিয়েও। এমন চিত্র উঠে এসেছে বিবিএস’র নিজেদের পরিচালিত এক জরিপে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সঙ্গে যৌথভাবে বিবিএস ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’ নামের এ জরিপ পরিচালনা করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিবিএসের তথ্য ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশই সংস্থাটির পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে নিভর্রযোগ্য মনে করেন না। ব্যবহারকারীদের ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মনে করেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কম। আর একেবারেই অনির্ভরযোগ্য মনে করেন ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ ব্যবহারকারী।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে গত দুই অর্থবছর জুড়েই মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও বিবিএস প্রকাশিত এ মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংস্থাটির দেওয়া মূল্যস্ফীতির তথ্যের ব্যবধান অনেক বেশি বলে দাবি করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে ‘সাউথ-এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মর্ডেলিংয় (সানেম)’ এর আগে ব্যাপক প্রশ্ন তুলেছিল।
পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও। এ নিয়ে বিরোধ বেঁধে যায় তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে। এমনকি তখনকার বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের চাকরি নিয়েও সে সময় টানাটানি শুরু হয়েছিল বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ও বর্তমানে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৭ সালের কথা। সে সময় বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। সেটির এক তৃতীয়াংশই ছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে। আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু তার হিসাবের সঙ্গে রেলিভেন্ট অন্যান্য বিষয়ের মিল নেই। তাহলে প্রবৃদ্ধি এত বেশি হচ্ছে কীভাবে। এটি নিয়ে নিউজ হওয়ার পর তখনকার পরিকল্পনামন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। পর দিন আমাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফানকে ডেকে দেড় ঘণ্টা রাগ ঝাড়েন। আমরা পরে দুই পৃষ্ঠার একটি ব্যাখাও দিয়েছিলাম।’
ড. জাহিদ বলেন, ‘এতদিন পরিসংখ্যান ব্যুরোকে যেকোনো তথ্য দিতে গেলে শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রীই নন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরেরও অনুমোদন নিতে হতো। এখন সে অবস্থা নেই। পরিকল্পনা উপদেষ্টাওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেই দিয়েছেন, এখন আর অনুমোদনের দরকার নেই। এখন প্রকৃত তথ্য প্রকাশের চর্চাটা করতে হবে বিবিএসকে। ভয় ও শঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে।’
সদ্য প্রকাশিত জরিপের তথ্য মতে, বিবিএসের তথ্যকে কম নির্ভরশীল মনে করে ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ মানুষ। এর পরই ২৬ শতাংশ মানুষ ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দিহান। এর মাধ্যমে জিডিপির হিসাব-নিকাশ হয়। আর ২৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ আয় ও দারিদ্র্যের হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষের। ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ শিল্প, শ্রমিক ও শিক্ষা পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিধায় থাকে।
এছাড়া ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করছে, সংস্থাটির তথ্য নির্ভরশীল। প্রায় ১৯ শতাংশ মানুষ বিবিএসের তথ্যকে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনীয় মনে করছে। ৮০ শতাংশ ব্যবহারকারী বলছেন, প্রয়োজনীয় ডাটা পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত না। জরিপে উঠে আসে, সব মিলিয়ে ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী মনে করেন, বিবিএসের তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়। এতে উঠে আসে, ৪২ দশমিক ৮৮ শতাংশ ব্যবহারকারী বিবিএসের তথ্য প্রকাশের ধারাবাহিকতা নিয়ে অসন্তুষ্ট। প্রায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ ব্যবহারকারী এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
এ সব বিষয়ে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন সম্প্রতি বিবিএস-এ অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি এই জায়গায় আসার আগে মনে করেছিলাম, বিবিএস বানিয়ে রিপোর্ট দেয়। কিন্তু এই ধারণা ভুল। এখন এসে দেখছি বিবিএসের দক্ষ কর্মীরা অনেক পরিশ্রম করে এবং আইন-কানুন মেনেই প্রতিবেদন তৈরি করে। এখানে বানানোর সুযোগ কম।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে ২৫টি সূচক বিবেচনায় স্কোর তালিকা তৈরি করেছিল। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল ১০০-এর মধ্যে ৮০, আর পদ্ধতিগত স্কোর ৭০। কিন্তু এর পর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সার্বিক স্কোর দ্রুত কমে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম