জুনেই ‘ইউনূস হঠাও’ আন্দোলন!
১৪ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৫১
ঢাকা: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘যৌক্তিক সময়ে’র মধ্যে নির্বাচন আয়োজন না করলে বা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে আগামী জুনেই ‘ইউনূস হঠাও’ আন্দোলনে যাবে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। এ ক্ষেত্রে ‘ন্যূনতম দাবি’ আদায়ের এক ও অভিন্ন কর্মসূচিতে বিএনপির সঙ্গেই রাজপথে দেখা যেতে পারে চির প্রতিন্দ্বদ্বী আওয়ামী লীগকেও।
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাস পাওয়া গেছে। সেপ্টেম্বরব্যাপী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ধারাবাহিক বৈঠকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দিতে সরকার বাধ্য। আমরা প্রত্যাশা করছি, দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ শেষ করে আগামী জুনের মধ্যে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ বা তফসিল ঘোষণা করবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেভাবে আন্দোলন করেছি, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও সেভাবে আন্দোলন করব।’
এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না— জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের ধারাবাহিক বৈঠক তো মহসচিবের (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) অসুস্থতার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তবে যে কয়েকটা বৈঠক হয়েছে, সেখানে নির্বাচন ও সংস্কার— দুটি বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সেখানে অবধারিতভাবে আন্দোলনের বিষয়টিও এসেছে।’
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে মোটামুটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা। ‘সংস্কার শেষে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে’— সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যে আশার আলো দেখেন তারা।
কিন্তু এক সপ্তাহে পরই ১ অক্টোবর সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য তুরে ধরে ড. ইউনূসের কাছে ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, এটা কি ধরে নেওয়া যায় যে এই সরকারের মেয়াদ ১৮ মাস?
জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা সরকারের মতামত না। সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে, সেটা সরকারকে বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, তখন সেটাই হবে তারিখ। উপদেষ্টা পরিষদে আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি, কিন্তু এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’
জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যেকে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ এবং রাজনীতির জন্য ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে নেয় বিএনপি। তাদের স্মৃতিপটে ওয়ান-ইলেভেনের ‘বিরাজনীতিকরণ’ ও ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ ভেসে ওঠে। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয়— এ বিষয়ে জোরালো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হবে।
এরপর গত ৫ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস সাহেবের নেতৃত্বে যে সরকার, সেই সরকারকে অবশ্যই সময় দিচ্ছি, সময় দেবো। কিন্তু বারবার প্রশ্ন আসে— কতদিন সময় দেবো? আমরা সেই পর্যন্ত সময় দেবো, যে পর্যন্ত একটা যৌক্তিক সময়ে তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমরা আন্দোলন করেছি, জান দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি একটা লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্যটা হচ্ছে— আমরা জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমরা বিরাজনীতিকরণের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা মাইনাস টু দেখতে চাই না। মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদ দেখতে চাই না। আমরা সন্ত্রাস দেখতে চাই না। আমরা সত্যিকার অর্থে দেশে সুস্থ, উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখতে চাই। তার জন্য আমরা তাদের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) হাতে দায়িত্ব দিয়েছি। আমরা মনে করেছি, এরা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা) যোগ্য মানুষ। এদের অতি দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করতে হবে।’
ওই দিনই বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘যমুনা’য় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্তবর্তীকালীন সরকারের মধ্যে দুয়েকজন আছেন, যারা বিপ্লব-গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ব্যাহত করছেন, তাদের সরানোর কথা বলেছি। কবে নির্বাচন করবে, সে ব্যাপারে একটা রোড ম্যাপ দিতে বলেছি।’
সূত্রগুলো বলছে, শুধু নির্বাচন নয়, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘৩২ নম্বর’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার ‘রিসেট বাটন পুশ’ সংক্রান্ত বক্তব্যও ভালোমতো নেয়নি বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল বিএনপি। এ নিয়েও দলীয় ফোরামে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের পর এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লেগেছে, যখন আমি দেখেছি বিজয় সরণির সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের যে মূর্তিটা ছিল, অসংখ্য মানুষ সেই মূর্তিকে দড়ি বেঁধে টেনেহিচড়েঁ ফেলে দিচ্ছে। খারাপ লেগেছে কেন? তিনি তো আমাদের নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তো তার বিরাট ভূমিকা ছিল।’
জানা গেছে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ‘সেনাসমর্থিত’ অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অতি আগ্রহে’র বিষয়টিও সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপির হাইকমান্ড। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের সমন্বয়ে একটি ‘ইসলামিক শক্তি’র উত্থান ঘটতে যাচ্ছে এবং সেখানে বর্তমান সরকারের ‘প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা’ আছে— এমন শঙ্কা থেকে বিএনপি চাইছে রাজনীতির মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে। সেক্ষেত্রে আগামী জুন মাস থেকেই দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে ‘ইউনূস হঠাও’ আন্দোলন যেতে পারে দলটি।
গত ৯ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আপনাদের (অন্তর্বতী সরকার) ভেতর থেকে যদি কেউ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে চায়, আমি শুধু বলে রাখতে চাই— আমরা আন্দোলন থেকে ইস্তফা দিইনি। কারও যদি অশুভ উদ্দেশ্য থাকে, আমরা আন্দোলনী ঝড়ের আর্তনাদ শোনাব। যদি নিজেরা শুধরে না যান, যদি সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে রহস্য থাকে, তাহলে প্রতিরোধ ঝড়ের কাব্য শোনাব।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের মধ্যে কেউ কেউ এক চোখা দৃষ্টিতে দেখে! বিএনপি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। ১৬/১৭ বছর নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, গুম-খুনের শিকার হয়ে, অসংখ্য নেতাকর্মী পঙ্গুত্ব বরণ করে, চোখ অন্ধ করে সাফল্য ছিনিয়ে আনা দল বিএনপি। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, কোনো কোনো উপদেষ্টা এক চোখে দেখার চেষ্টা করছেন। সংস্কারের নামে যদি নির্বাচন দীর্ঘায়িত করা কয়, তাহলে মানুষ আপনাদের সন্দেহ করবে। কী এমন ঘটনা আছে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করতে পাচ্ছেন না?’
রোববার (১৩ অক্টোবর) এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য কতটুকু সময় লাগবে, বলেন না কেন? সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন ১৮ মাস, পরের দিন কেন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে এটা সরকারের কথা না? তাহলে সরকারের কথাটা কী? ৩৬ মাস, ৩০ মাস— তাই বলেন না! বলতে তো হবে আপনাকে। আপনাকে তো সময় বলতে হবে। আমরা যদি জানতে পারি আপনারা এত মাস পরে নির্বাচন করবেন, আমাদের তো কাজ আছে, আমাকে জনগণের কাছে যেতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মাত্র দুই মাসের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের এই কঠোর সমালোচনা মূলত মাঠের আন্দোলনের পূর্বপ্রস্তুতি। ঘটনা যাই ঘটুক, আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল বা রোডম্যাপ না দিলে সমমনা দল ও জোটকে নিয়ে ইউনূস হঠাও আন্দোলনে যাবে বিএনপি। তবে এ ব্যাপারে এখন সরাসরি কিছু বলতে চান না দলটির শীর্ষ নেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে দুই মাস সময় পার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আশা করব, আগামী জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল বা রোডম্যাপ ঘোষণা করবে তারা। নইলে জুনের পর আন্দোলন।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলন জাতীয় নির্বাচন ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন নির্বাচনি রোডম্যাপ বিএনপি