তৃণমূলে ‘সুসংগঠিত’ আ.লীগ সুযোগের অপেক্ষায়
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ১২:১৯
ঢাকা: দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা চার মেয়াদে সরকার গঠন করেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজে ইতিহাস গড়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছিলেন। জানুয়ারিতে গঠন করেন নতুন সরকার। সাত মাসের মাথায় সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের জের ধরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে সেই সরকারের। ঢাকামুখী জনতার প্রবল জোয়ারের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন কেবল নয়, দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ পতিত হয় ঘোর অন্ধকারে। একের পর এক মামলা হতে থাকে শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে। তৎক্ষণাৎ গা ঢাকা দেন তারা। কেউ কেউ গ্রেফতার হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। মামলা-হামলা আর ‘মব জাস্টিস’ আতঙ্কে তৃণমূলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রয়েছেন নিশ্চুপ। ফেসবুক পেজ থেকে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া দলটির কোনো কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়।
রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনাও আছে— পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ ‘নাই’ হয়ে গেছে! আওয়ামী লীগ আদৌ আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না, রয়েছে সে প্রশ্নও। আবার আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরলে দলের হাল কার হাতে থাকবে— সে প্রশ্নও করছেন অনেকেই।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, আচমকা এক ‘ঝড়ে’র কবলে পড়েছে তাদের দল। এতে সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মাঠে দেখা না গেলেও সাংগঠনিকভাবে দল অটুট রয়েছে। এত ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও তৃণমূল আওয়ামী লীগ আগের মতোই ‘সুসংগঠিত’। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কেউই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রজি হননি।
কেন্দ্রীয় নেতাদের যে দুয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে তারা বলছেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি, ফলে তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বন্দুকের নলের মুখে তাকে দেশ ছাড়তে হলেও বিদেশে থেকেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। কেবল সময় ও সুযোগ খুঁজছে দলটি। অনুকূল পরিস্থিতি পেলেই আওয়ামী লীগ আগের মতোই রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াবে।
আওয়ামী লীগের জন্য এমন ক্রান্তিকাল এর আগে এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। দলের প্রাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন। আড়াই মাসের মাথায় হত্যা করা হয় কারাবন্দি জাতীয় চার নেতাকে। নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগে দেখা দেয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দেওয়ান ফরিদ গাজী ও আব্দুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। এর বাইরে দল থেকে বেরিয়ে আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও এম এ জি ওসমানী আলাদা দল গঠন করেন।
প্রায় ছয় বছর পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। দেড় দশকের মাথায় সেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পায় জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে। একটি পূর্ণ মেয়াদের নির্বাচিত সরকার ও দুই বছরের সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষে ফের ক্ষমতায় আসে দলটি। রাষ্ট্রপরিচালনা করে টানা ১৬ বছর।
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ দেশের অবকাঠামো খাতসহ আর্থসামাজিক বিভিন্ন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। এ অবস্থায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মদতপুষ্ট স্বাধীনতাবিরোধী ‘অপশক্তির ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা বলছেন, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাই ছিল এই ‘ষড়যন্ত্রে’র মূল লক্ষ্য। সেটি সম্ভব না হলেও তাকে জোর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা এখনো পদত্যাগ না করায় সংবিধান অনুযায়ী তিনিই বংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী— এমনটিই বিশ্বাস আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। যদিও ৫ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে স্পষ্টই বলেছিলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অপশক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। বন্দুকের নলের মুখে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আওয়ামী লীগকে হটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে এখন মব জাস্টিস চলছে। মব জাস্টিস যারা করছে, তাদের ইনডেমনিটিও (দায়মুক্তি) দেওয়া হয়েছে। হত্যা করলে, লুটতরাজ করলেও তাদের বিচার হচ্ছে না। মামলা পর্যন্ত আদালতে নিচ্ছে না। মোট কথা, দেশে কোনো আইনের শাসন নেই। সংবিধান অনুযায় দেশ পরিচালনা হচ্ছে না।’
এদিকে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সরকারের নানা পর্যায়সহ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলছেন, গণহত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। তবে বিভিন্ন মহল থেকে নতুন নেতৃত্বের অধীনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের আলোচনা রয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, নেতৃত্বের কোনো সংকট বর্তমান আওয়ামী লীগে নেই। তৃণমূলের একাধিক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি শেখ মুজিব-নির্ভর দল ছিল। ওই সময় তাকে হত্যার পর তাই দলের নেতৃত্ব নিয়ে সংকট তৈরি হয়। এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে মুজিব সেনা রয়েছে। শেখ হাসিনা যেখানেই থাকুন, সেখান থেকেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত অবস্থাতেই রয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের আত্মগোপনে থাকা নেতারাও কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
এদিকে সরকার পতনের পরপর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছিলেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। কয়েকদিন পর অবশ্য তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে শেখ হাসিনা অবশ্যই বাংলাদেশে ফিরবেন। পরে দলের জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার কথা বলার কলরেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।
নেতাকর্মীরা বলছেন, এখনো শেখ হাসিনার সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগ বহাল রয়েছে। সময় ও সুযোগ মিলে গেলেই আওয়ামী লীগ মাঠের রাজনীতিতে ফিরে আসবে।
জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মব জাস্টিসের কারণে নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছে। আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী দেশে আত্মগোপনে আছে এবং যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, তাদের পরিবারের ওপরও অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চলছে। অথচ এসব নিয়ে সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর মুখ বন্ধ। এ অবস্থায় আমরা সবাই সুযোগের অপেক্ষায় আছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে চলে আসবে।
নাছিম আরও বলেন, তারা রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু তাদের ওই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। কারণ আওয়ামী লীগ একটি বিশাল দল। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল। সারা দেশে এই দলের শিকড় বিস্তৃত। আওয়ামী লীগের হাল শেখ হাসিনার হতেই আছে। তিনি প্রতিটি পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। চলমান পরিস্থিতির কারণে নিজেদের মধ্যে সুসংগঠিত থেকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তার নির্দেশে চুপ রয়েছি। পরিস্থিতি বুঝে তিনি নির্দেশ দিলেই আওয়ামী লীগ আবার মাঠে ফিরবে।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
আওয়ামী লীগ গণঅভ্যুত্থান ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেখ হাসিনা সরকার পতন