Tuesday 19 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছিলেন বিমা কর্মকর্তা, এমপি হয়েই সম্পদশালী-গডফাদার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ২০:৩১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: একটি বেসরকারি বিমা কোম্পানির সাধারণ কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আকস্মিক দলটির মনোনয়ন পেয়ে যান। মনোনয়ন নয়, যেন আলাদীনের চেরাগ! পর পর দুটি একতরফা নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই শুরু। অবাধ দুর্নীতি আর লুটপাটে বিমা কোম্পানির কর্মকর্তা থেকে হয়ে যান বিপুল সম্পদশালী।

শুধু লুটপাট নয়, এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিল, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি– কেউই তার রোষানল থেকে বাদ যায়নি। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জুটে গডফাদারের তকমাও। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন থানায় ঢুকে পুলিশকে মারতে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতাও বাতিল করে। তিনি হলেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের একেবারে সর্বদক্ষিণের বঙ্গোপসাগর তীরের এ জনপদে একসময় যার ইশারা ছাড়া ‘গাছের পাতাও নড়তো না’, সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি এখন লাপাত্তা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের তদন্ত শুরু করেছে। বুধবার (১৬ অক্টোবর) দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে মোস্তাফিজুর ও তার স্ত্রীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

একসময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দুই দশকেরও বেশিসময় ধরে তিনি দলটির বাঁশখালী উপজেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বাঁশখালী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতা (বর্তমানে প্রয়াত) সুলতানুল কবির চৌধুরী। এর পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তিনি আর জিততে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির সময়ও সুলতানুল কবির চৌধুরীর মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু তিনি বেঁকে বসেন, আর নির্বাচন করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এতে কপাল খুলে যায় মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর। আওয়ামী লীগ তাকেই প্রার্থী করে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচনে ‘হেসেখেলেই’ জিতে আসেন তিনি।

বাঁশখালীর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, প্রথম দফা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই নিজের অনুসারীদের নিয়ে একটি বলয় গড়ে তোলেন মোস্তাফিজুর। গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, নানাবিধ সরকারি অনুদান, টেন্ডারের কমিশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজের লোক বসিয়ে অনিয়ম, চাঁদা আদায়, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, সরকারি সোলার প্যানেল স্থাপন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতসহ এমন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি নেই, যা তারা করেননি।

অভিযোগ আছে, বাঁশখালীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাগরতীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় ২৯৩ কোটি টাকায়। নামমাত্র কাজ করে এই টাকার বড় অংশ আত্মসাত করা হয়েছে। এ ছাড়া মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর দুই মেয়াদে আরও অন্তত ১২০০ কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দ আসে বিভিন্নখাতে। এর সিংহভাগই লুটপাট হয়েছে, যা নিয়ে এখন দুদক অনুসন্ধানে নেমেছে। অবাধে লুটপাটের মাধ্যমে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যরা মাত্র ১০ বছরে ফুলে-ফঁপে উঠেছেন। ১০ বছরের ব্যবধানে তার আয় বেড়ে যায় প্রায় ২১৭ গুণ।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী, মোস্তাফিজুর রহমান ১১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৪ টাকার মালিক ছিলেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন মাত্র ১৫ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর হাতে নগদ ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং পারিবারিকভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমার পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। মোস্তাফিজুর রহমানের ৪ একর কৃষিজমি ছিল। ঢাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে পাওয়া তিন কাঠার একটি প্লট ছিল। এছাড়া স্বামী-স্ত্রীর আর কোনো স্থাবর সম্পত্তি ছিল না।

২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় দেখা গেছে, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৬৫ টাকা। বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ভাড়া, সংসদ সদস্য ভাতা, বিমা কোম্পানির পরামর্শকের চাকরি থেকে এ আয় দেখানো হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা দেখানো হয় ২০ লাখ টাকা। স্থায়ী আমানত দেখানো হয় ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮৭৫ টাকা। দৃশ্যমান আয় না থাকলেও মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রীর আয় দেখানো হয় ৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে একটি বাড়ির তথ্যও আছে হলফনামায়।

সংসদ সদস্য হওয়ার আগে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর কোনো গাড়ি ছিল না। নির্বাচিত হওয়ার প্রথম মেয়াদে তিনি ১ কোটি ২২ লাখ টাকা দামের প্রাডো জিপের মালিক হন। পরের মেয়াদে তিনি ল্যান্ডক্রুজার স্টেশন ওয়াগন গাড়ি কেনেন।

ক্ষমতার দাপট, পরোয়া করতেন না কাউকেই

অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাটে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী যতটা না আলোচিত ছিলেন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য তার চেয়েও বেশি সমালোচিত হয়েছেন। মতের সঙ্গে না মিললে নিজ দলের শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে যেভাবে ‘কামান দাগিয়েছেন’, তেমনি নিজ এলাকার লোকজনকেও ভয়ভীতির মধ্যে রেখেছিলেন। রেহাই মেলেনি সরকারি কর্মকর্তাদেরও। কোণঠাসা করে রেখেছিলেন নিজের মতের বিরুদ্ধে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।

২০১৬ সালে নিজের পছন্দের চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করায় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহেদকে তার কার্যালয়েই মারধর করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ওই ঘটনার পর এমপির বিরুদ্ধে আহত নির্বাচন কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন।

২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে তৎকালীন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুরের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছিল। আবার প্রকাশ্য সভায় অপদস্থ করেছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানকেও।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ডা. আশরাফ আলী খানকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদে ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধারা মানববন্ধন করছিলেন। মোস্তাফিজুরের অনুসারীরা সেই মানববন্ধন হামলা করে পণ্ড করে দেয়।

বাঁশখালীতে ২০২৩ সালের ২২ মে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে মিছিলে নেতৃত্ব দেন মোস্তাফিজুর। নিজের ফেসবুক পেইজে সেই ছবিও আপলোড করা হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। এর মধ্যেই তিনি আরেক সমাবেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ‘ডাইরেক্ট’ গুলি করার হুমকি দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন।

এত আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। এ ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

এরপর ১৮ ডিসেম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এক সমর্থককে ‘তোর ভাইকে সাবধান করে দিস, নয়তো হাঁটুনলা ভেঙ্গে দেব’- মোবাইলে এমন হুমকি-ধমকি দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ৫ জানুয়ারি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া মোবাইলে কথোপকথনের একটি অডিওতে তাকে বাঁশখালী থানার তৎকালীন ওসি তোফায়েল আহমেদকে ‘হাত কেটে নেয়ার’ হুমকি দিতে শোনা যায়।

৭ জানুয়ারি সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর পর কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগে এক সমর্থককে আটকের পর মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী কয়েকজনকে নিয়ে থানায় ঢোকেন। এ সময় ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের ওপর চড়াও হওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওসি তোফায়েল আহমেদকে তিনি মারার জন্য তেড়ে যান। এ ঘটনার পর নির্বাচন কমিশন ভোট শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে তার প্রার্থিতা বাতিলের ঘোষণা দেয়। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল।

এছাড়া বাঁশখালীর বাসিন্দা ও স্থানীয় সাংবাদিকদেরও নিয়মিত হুমকি-ধমকির মধ্যে রেখেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তার অপকর্ম নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করায় সাংবাদিককে শফকত হোসাইন চাটগামীকে মেরে হাড্ডি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সাংবাদিক রাহুল দাশ নয়নকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন। সাংবাদিক ফারুক আবদুল্লাহকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলার আসামি করে হয়রানি করেছিলেন।

বাঁশখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা শফকত হোসাইন চাটগামী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর শিক্ষা, রুচি, মন-মানসিকতা খুবই নিম্নমানের ছিল। এমপি হলেও তার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাধারণ মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার এবং গালিগালাজ এটা তার অন্যতম চরিত্র ছিল। রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধি- এ দুটোকে তিনি ব্যবসা হিসেবে নিয়েছিলেন। পদ-পদবি ব্যবহার করে টাকা কামানোই তার নেশা এবং পেশা ছিল। তার মতো এত লোভী ও গডফাদার কোনো জনপ্রতিনিধি বাঁশখালীর ইতিহাসে আর আসেনি।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

এমপি বিমা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর