দখল-চাঁদাবাজির ‘মচ্ছবে’ নেতারা, জিরো-টলারেন্স নীতিতে বিএনপি
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:০৪
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের মচ্ছবে যোগ দিয়েছে বিএনপির একটি অংশ। এদের বিরুদ্ধে জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে দলটি। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গত দুই মাসে এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বহিষ্কার, অব্যাহতি, পদাবনতি ও কমিটি বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতেও পিছপা হয়নি দলটি।
বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সেল থকে জানা গেছে, গত দুই মাসে এক হাজার ২৩ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫২৩ জনকে কারণ দর্শানোর নেটিশ, ৪৩৭ জনকে বহিষ্কার, ২৪ জনের পদ স্থগিত, ৩৫ জনকে সতর্ক এবং চারজনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে আগে কখনো দেখা যায়নি।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া নেতাদের মধ্যে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন। এর মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর, আবার অনেকের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এসব নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও বিলকিস জাহান, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল উল্লেখযোগ্য।
৫ আগস্ট সরকার পতনের ছয় দিনের মাথায় গত ১১ আগস্ট বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) বিলকিস জাহানের পদ স্থগিত করার মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়। সর্বশেষ রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে সোমবার (১৪ আগস্ট) বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রবিউল আলমের দলীয় পদ স্থগিত করেছে দলটি। মামলা ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত দলের সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে তাকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের গাড়ি ব্যবহার করে নিজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় গত ২ সেপ্টেম্বর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে বিএনপি। ওই দিন বিকেলেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন তিনি।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ করে ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটি বাতিল করে বিএনপি। নেতৃত্ব ঘোষণার মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে কমিটি বিলুপ্তির কারণ জানানো না হলেও দলীয় নেতাকর্মীদের ধারণা, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরবের ‘চাঁদাবাজি’ ও সদস্যসচিব আমিনুল হকের অনৈতিকভাবে ‘অর্থ গ্রহণ’-এর অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
জানা গেছে, সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে দখল ও চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়েছে। আর সাবেক ফুটবলার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরের বিতর্কিত ব্যবসায়ী তরফদার রুহুল আমিনের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তরফদার রুহুল আমিন চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার সমর্থনে মাঠে নামেন আমিনুল হক, যদিও ফেডারেশনের সভাপতি পদে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়ালও একজন প্রার্থী।
এ ঘটনায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আমিনুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনের লোকেরা আমাকে বলেছেন, তরফদার রুহুল আমিন হলে ফেডারেশনের ভালো হবে। খেলাধুলা নিয়ে তার আগ্রহ আছে। যেহেতু আমরা ক্রীড়াঙ্গনকে দলীয়করণ করব না, সে জন্য আমি সমর্থন দিয়েছি। আর তাবিথ আউয়াল যে প্রার্থী হবেন, সেটা আমি জানতাম না।’
এদিকে সাইফুল আলম নিরব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার প্রতিপক্ষ আগে থেকেই আমাকে চাঁদাবাজ বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি কোথায় চাঁদাবাজি করেছি, কার বাড়ি, দোকান দখল করেছি— এসবের কোনো প্রমাণ নেই।’
ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটি ছাড়াও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও খুলনা জেলা কমিটিও বাতিল করেছে বিএনপি।
তবে অভিযুক্ত সব নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি— এমনটি নয়। অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এদের মধ্যে বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েমসহ (মুন্না) অন্যতম।
জানা গেছে, নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে রফতানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের কাছে অর্থ দাবি, আবু আশফাকের নেতৃত্বে বায়রা ভবনে ভাঙচুর, রফিকুল আলম মজনুর বিরুদ্ধে শান্তিনগরের ‘ইস্টার্ন প্লাস’ মার্কেটের কমিটি দখলসহ ঢাকা ও ফেনীর বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, আবদুল মোনায়েম মুন্নার বিরুদ্ধে এক পরিবহন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম নয়নের বিরুদ্ধে। সরকার পতনের মাত্র পাঁচ দিন পর ১১ আগস্ট ব্যবসায়ী এস আলমের পক্ষ হয়ে রাজধানীর মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে দখল নিতে যাওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। রবিউল ইসলামকে সেদিন সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়। ওই ঘটনায় ইসলামী ব্যাংকের অন্তত ছয় কর্মী গুলিবদ্ধ হন। কিন্তু রবিউল ইসলাম নয়নের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএনপি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে দখলদারি, চাঁদাবাজি বা অন্য কোনো অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এরই মধ্যে অনেককেই বহিষ্কার করা হয়েছে, অনেকের পদ স্থগিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে একটা বার্তা দিতে চাই— বিএনপির কোনো পদে থেকে দুর্বৃত্তায়ন চলবে না।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর