Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যশোর বোর্ডে ৭ কোটি টাকার চেক জালিয়াতি: ৩ বছর পর মামলার এজাহার দায়ের

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:০২

যশোর: যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রায় সাত কোটি টাকার চেক জালিয়াতির ঘটনায় তিন বছর পর মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় আসামি করা হয়েছে ১১ জনকে। তবে শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন ও শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে এই এজাহার দাখিল করা হয়। সাবেক ওই চেয়ারম্যান ও সচিব চাকরি থেকে অবসর নেওয়ায় বোর্ডের তৎকালীন উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) মো. এমদাদুল হক ও অডিট অফিসার মো. আব্দুস সালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ পাঠিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল। বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন, সাবেক সচিব অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজা ও হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম এবং যশোরের রাজারহাটের ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক শেখ শরিফুল ইসলাম বাবু ও শেখহাটি হাইকোর্ট মোড় এলাকার শাহীলাল স্টোরের মালিক আশরাফুল আলমকে মামলার আসামি করা হয়েছিল।

বুধবার দায়ের করা মামলাতেও আগের মামলার তিন আসামি মো. আব্দুস সালাম, শেখ শরিফুল ইসলাম বাবু ও আশরাফুল আলমকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলার বাকি আট আসামি হলেন— পোস্ট অফিস পাড়ার নূর এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মো. গাজী নূর ইসলাম, লোহাপট্টি জামে মসজিদ এলাকার প্রত্যাশা প্রিন্টিং প্রেসের প্রোপ্রাইটর রূপালি খাতুন, নতুন উপশহরের মো. সহিদুল ইসলাম, সোনেক্স ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটর মো. রকিব মোস্তফা, বোডের্র সহকারী ‍মূল্যায়ন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ, নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর (ক্যাশিয়ার) মো. জুলফিকার আলী, নিম্নমান সহকারী (চেক ডেসপাসার) মো. মিজানুর রহমান এবং সাধারণ কমর্চারী (চেক ডেসপাসার) মো. কবির হোসেন।

বিজ্ঞাপন

শতাধিক পৃষ্ঠার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবরের মামলা তদন্ত শেষে মোট ১১ জন আসামির বিরুদ্ধে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ৩৮টি চেক জালিয়াতি করে মোট ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার তিন টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযোগপত্র সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালত), যশোরে দাখিল করা হয়েছে।

দুদক বলছে, তদন্তে যশোর শিক্ষা বোর্ডের ২৫টি হিসাব সোনালী ব্যাংক বোর্ডিং শাখা, যশোরে পরিচালিত হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত ওই ব্যাংকের একটি হিসাবে ৩৮টি চেক জালিয়াতি করে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দিয়ে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বোর্ডের ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৬ টাকার জায়গায় মোট ছয় কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৭ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার তিন টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

দুদকের এজাহার অনুযায়ী, জালিয়াতি হওয়া ৩৮টি চেকের মধ্যে টিএ/ডিএ বিল বাবদ আসামি আব্দুস সালামের নামে তিনটি চেক, সাধারণ বিল বাবদ সহকারী সচিব আশরাফুল ইসলামের নামে একটি চেক, মিম প্রিন্টিং প্রেসের নামে তিনটি চেক, মেসার্স খাজা প্রিন্টিং প্রেসের নামে দুটি চেক, নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি চেক, সবুজ প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি চেক, শরিফ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামে একটি চেক, সানিয়া ইলেক্ট্রনিক্সের নামে একটি চেক, শাহী লাল স্টোরের নামে একটি চেক, দেশ প্রিন্টার্সের নামে একটি চেক, সেকশন অফিসার আবুল কালাম আজাদের নামে একটি চেক, অর্পানেটের নামে একটি চেক, আয়কর কর্তন বাবদ চারটি চেক ও ভ্যাট কর্তন বাবদ ইস্যু করা ছয়টি চেক ছিল।

এসব চেকের মধ্যে আব্দুস সালামের নামের তিনটি চেক ও শাহী লাল স্টোরের নামের মোট ১৬টি চেক আব্দুস সালাম নিজে রিসিভ করেন। সহকারী সচিব আশরাফুল ইসলামের নামের একটি ও সেকশন অফিসার আবুল কালাম আজাদের নামের একটি চেক তারা নিজেরাই রিসিভ করেন। বাকি ২২টি চেক আসামি শেখ শরিফুল ইসলাম ডেসপাস রাইডার মো. জুলফিকার আলী, মো. মিজানুর রহমান ও মো. কবির হোসেনের সহায়তায় নিজে ‘শাহারাজ’, ‘জাফর’, ‘আ. কাশেম’, ‘আরিফুল’, ‘শরিফ’, ‘সোহাগ’, ‘নুর ইসলাম’, ‘ইকবাল’ ও শরিফুল’ নামে জাল সই করে গ্রহণ করেন। তিনি এর আগে ওই ২২টি চেক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্যাডে জালিয়াতির মাধ্যমে কার্যাদেশ পেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের প্যাড ও তাদের নামের সই জালিয়াতি করে মালামাল সরবরাহ করে বোর্ডে বিল জমা দিয়েছিলেন।

আত্মসাৎ করা টাকা কে কোথায় কার সঙ্গে কী পরিমাণে ভাগাভাগি করেছে, সে বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য দুদক এজাহারে উল্লেখ করেছে। কোন চেক কোন ব্যাংওকর কোন শাখায় ক্লিয়ারিং করা হয়েছে, সেসব তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। দুদক জানিয়েছে, তদন্তে ৩৮টি চেকই বিশারদের মাধ্যমে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে।

এজাহারে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, ৩৮টি চেক ডেসপাস হওয়ার পর টেম্পারিং হয়েছে এবং টেম্পারড চেক ক্লিয়ারিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে উপস্থাপিত হয়েছে। আব্দুস সালাম ও শেখ শরিফুল ইসলাম মূলত টেম্পারিংয়ের জন্য দায়ী এবং তারা আলোচ্য মামলার মূল অপরাধী। তারা দুজন যোগসাজশে বাকি ৯ আসামির প্রত্যক্ষ সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় পৌনে সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিজের ও স্ত্রী-স্বজনদের নামে সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে কিছু সম্পদ তদন্তের সময় আদালতের আদেশের মাধ্যমে অবরুদ্ধ ও ক্রোক করা হয়েছে।

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, চেক জালিয়াতির সময়কাল অর্থাৎ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত যশোর শিক্ষা বোর্ডে দুজন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল আলীম ও অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন কর্মরত ছিলেন। একই সময়ে ড. মোল্লা আমীর হোসেনসহ তিনজন সচিব কর্মরত ছিলেন। ড. মোল্লা আমীর হোসেন প্রথমে সচিব ছিলেন, পরে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বাকি দুই সচিব হলেন অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজা ও অধ্যাপক মো. তবিবার রহমান।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল আলীম চেয়ারম্যান থাকাকালে মোট ২২টি এবং অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন চেয়ারম্যান থাকাকালে ১৬টি চেক জালিয়াতি হয়। তারা দুজন ওই ৩৮টি চেকে চেয়ারম্যান হিসেবে সই করেছেন। এ ছাড়া ওই ৩৮টি চেকের মধ্যে ড. মোল্লা আমীর হোসেনের সচিব হিসেবে সই রয়েছে ১২ টিতে, অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজার সচিব হিসেবে সই রয়েছে পাঁচটিতে এবং অধ্যাপক মো. তবিবার রহমানের সচিব হিসেবে সই রয়েছে ২১ টি চেকে।

দুদক বলছে, চেক জালিয়াতি বা টেম্পারিংয়ে সিগনেটরি হিসেবে বোর্ডের এসব চেয়ারম্যান ও সচিবের দালিলিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। কারণ চেকগুলো তাদের সইয়ের মাধ্যমে ডেসপাস হওয়ার পর টেম্পারিং হয়েছে। এ ছাড়া টেম্পারড চেক তাদের নামের কোনো ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি বা চেক টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া টাকা তাদের নামের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে জমা হওয়ার রেকর্ডও তদন্তের সময় পাওয়া যায়নি। এ কারণে ওই সময়ে দায়িত্ব পালন করা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিবদের দুদকের মঞ্জুরির ভিত্তিতে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়ছে।

তবে চেয়ারম্যান ও সচিবদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করছে দুদক। সংস্থাটি বলছে, জালিয়াতির সময়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডে কোনো অভ্যন্তরীণ অডিট হয়নি। প্রতি অর্থবছর শেষে একটি হিসাব মেলানোর ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে সচিবের নেতৃত্বে বোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের উপপরিচালক এমদাদুল হক ও নিরীক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম আজাদ কাজ করেছেন। কিন্তু ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পরিচালিত হিসাব মেলানোর প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, তারা সংগঠিত জালিয়াতি সঠিক সময়ে উদ্‌ঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একে সুস্পষ্টভাবে দায়িত্বে অবহেলা অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

২০২১ সালের অক্টোবরের প্রথম দিকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেক জালিয়াতি ও বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি জানাজানি নয়। দুদকের অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়া গেলে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে যশোর শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিশেষ জজ আদালতে মামলা করা হয়।

ওই মামলার তিন বছর পর দীর্ঘ তদন্ত ও নানা প্রক্রিয়ার পর আজ বুধবার মামলার এজাহার দাখিল করল দুদক। জানতে চাইলে দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল আমিন বলেন, ‘তদন্ত কাজ শেষে আজ (বুধবার) এই মামলায় এজাহার দেওয়া হয়েছে।’

সারাবাংলা/টিআর

চেক জালিয়াতি দুদক দুদক যশোর যশোর শিক্ষা বোর্ড

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর