পদত্যাগের চিঠিতে যা লিখলেন বেসিস সভাপতি রাসেল টি
১৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৪৪
ঢাকা: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি পদ থেকে রাসেল টি আহমেদ পদত্যাগ করেছেন। ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে তিনি বেসিসের কার্যনির্বাহী কমিটির পরিচালক পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) সকালে বেসিসের ২০২৪-২৬ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটি ও সাধারণ সদস্য বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন রাসেল টি আহমেদ। তিনি নিজেই পদত্যাগের তথ্য সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন।
চিঠির অনুলিপি বেসিস সচিবালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেড অরগানাইজেশন (ডিটিও) শাখাকে দেওয়া হয়েছে।
রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘ঘণ্টাদুয়েক আগে আমি বেসিস সভাপতি ও কার্যনির্বাহী পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
বেসিস কার্যনির্বাহী কমিটি ও সদস্যদের কাছে লেখা রাসেল টি আহমেদের পদত্যাগপত্রে তারিখ উল্লেখ নেই। তবে ইমেইলে তারিখ উল্লেখ আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পদত্যাগের দীর্ঘ চিঠিতে রাসেল টি আহমেদ তার মেয়াদের বেসিসের গ্রহণ করা বিভিন্ন নীতিমালার ফলে সদস্যদের উপকৃত হওয়ার তথ্য তুলে ধরেছেন। নানা আক্ষেপের কথাও লিখেছেন তিনি।
এ বছরের ৯ মে ২০২৪–২৬ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে বেসিস সভাপতি হন রাসেল টি আহমেদ। ১১ সদস্যের এই ইসিতে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে রয়েছেন সিসটেক ডিজিটালের রাশিদুল হাসান। রাসেল টি আহমেদের পদত্যাগে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনিই আপাতত বেসিস সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
পদত্যাগের চিঠিতে রাসেল টি আহমেদ লিখেছেন, প্রায় ২৪ বছর ধরে আমি তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কাজ করে চলেছি। আমি গর্বিত আমার কাজের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এবং সফটওয়্যার এই দুই খাতে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। বিগত ১২ বছর বেসিস সদস্যরা বিভিন্ন টার্মে আমাকে বোর্ডের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পালন করার সুযোগ দিয়েছেন। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন নির্বাহী পরিষদে (২০১২, ২০১৪, ২০১৬, ২০২২, ২০২৪) আপনাদের সরাসরি ভোটে আপনারা আমাকে নির্বাচিত করে বেসিস এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজ করার দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার প্রতি আপনাদের এই সমর্থন ও ভালোবাসা আমাকে সম্মানিত করেছে এবং আমি সারাজীবন আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
তিনি লিখেছেন, সর্বশেষ ২০২২-২৪ টার্মে সভাপতির দায়িত্ব পালন করার পর গত ৮ মে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রিয় বেসিস সদস্যরা আমাকে দ্বিতীয় মেয়াদের (২০২৪-২৬) জন্য সভাপতি নির্বাচন করেন। আপনারা সকলেই জানেন যে, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অদ্যাবধি বেসিস সদস্যরা সবসময় সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই নেতৃত্ব নির্বাচন করেছেন। এটাই বেসিসের শক্তি এবং এর শতভাগ কৃতিত্ব বেসিসের সকল সদস্যের।
বেসিস সভাপতি চিঠিতে লিখেন, সম্প্রতি জুলাই আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছে এক নতুন বাংলাদেশ। শহীদ আবু সাঈদ, মুদ্ধ, তানভীন, মামুনের মতো শত-শত ছাত্র জনতা তাদের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছে বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ গড়তে কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। অনেকগুলো মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে ছাত্রজনতার বৈষম্য বিরোধী সফল আন্দোলনের ফসল হিসেবে আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ পেলাম। এখন সময় নতুন বাংলাদেশ গড়ার। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে আমাদের তারুণ্যের মেধা। তাই আপনাদের সবার মত আমিও বিশ্বাস করি, নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিঠিতে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ লিখেছেন, এমন এক ভীষণ সংবেদনশীল সময়ে একত্রিত হয়ে কাজ করার পরিবর্তে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি করছে এবং এর পরিণামে পুরো আইসিটি পরিবারে একটি অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুই যুগের অধিক সময় ধরে গণতান্ত্রিক চর্চা করে যাওয়ার কারণে যেই বেসিস স্বনামধন্য অবস্থানে এসে পৌঁছেছে, সেই বেসিসের সুষ্ঠু নির্বাচনকেও আজ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নামে বেনামে বিভিন্ন শ্বেতপত্র প্রকাশিত হচ্ছে যা দেশে এবং বিদেশে এই শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। মনে রাখতে হবে, বেসিস সদস্যরা শুধু সরকারী কাজ করেন না, বরং আমাদের অধিকাংশ সদস্যই প্রাইভেট সেক্টরকে সেবা প্রদান করেন এবং বিদেশে সেবা রপ্তানি করেন। কিন্তু, এইসকল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সামগ্রিকভাবে আমাদের আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তদন্ত সাপেক্ষে বিচার হওয়া যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনিভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক কার্যক্রমের কারণে ২৬০০ বেসিস সদস্যের গৌরবময় অবদান যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
চিঠিতে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ আরও লিখেছেন, আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির এপেক্স ট্রেডবডি বেসিসের সদস্যরা তাদের ভালোবাসার কারণে একটু সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাকে পরপর দ্বিতীয়বারের মত সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আমার সীমাবদ্ধ সক্ষমতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে বেসিসের পতাকাকে আরো উঁচুতে তুলে ধরা এবং ভীষণ সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োগ করার সর্বাত্মক চেষ্টা আমি করেছি। আমার এই প্রচেষ্টায় অনিচ্ছাকৃত যেকোনো প্রকারের ভুল যা সীমাবদ্ধতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইল প্রিয় বেসিস সদস্যদের কাছে।
তিনি বলেন, আমি বর্তমান বেসিস সভাপতি শুধুমাত্র এই একটি পরিচয়ের কারণে নিকট অতীতে আমাকে নামে এবং বেনামে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে এইসব লক্ষ্য করা গেলেও বেসিসের কোনো সদস্যের কাছ থেকে আমি বা বর্তমান ইসি লিখিত কোনো অভিযোগ আজ পর্যন্ত পাইনি। বেসিস সভাপতি বা বোর্ডের উপর আনিত যেকোনো অভিযোগ ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ করে। সাংগঠনিক মানহানির চেষ্টার পাশাপাশি অতি সম্প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এবং আমার সন্তানদের জড়িয়ে এমন সব ভীতিকর মন্তব্যের মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছে যা আমার জন্য অকল্পনীয় এবং আমার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আশংকাজনক।
বেসিস সভাপতি লিখেন, এমতাবস্থায়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে, আমি বেসিস সভাপতি পদ থেকে এবং বেসিস বোর্ডের পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। একইসঙ্গে আপনাদের ভালোবাসায় দেয়া দায়িত্ব আমি সম্পূর্ণ সময় পর্যন্ত পালন করতে অপারগ হওয়ায়, বেসিসের সকল সম্মানিত সদস্যদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। একইসাথে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমার দারুণ ১০ জন ইসি কলিগের কাছে। এমন একটি দুর্দান্ত টিমের সঙ্গে সম্পূর্ণ সময় কাজ করার সুযোগ আমার হল না, এটা আমার দুর্ভাগ্য। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প আমার জন্য একটি ভালোবাসার জায়গা। বাংলাদেশের আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়া যাওয়ার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে অবদান রাখার চেষ্টা করে যাব সবসময়, ইনশাআল্লাহ।
সারাবাংলা/ইএইচটি/ইআ