‘রিসেট’ হোক সকলের ভাষা-পরিভাষা
১৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৫২
বছরজুড়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ধকল সামাল দিতে হচ্ছে বিশ্বকে। অগমেন্টেড রিয়েলিটির যুগে উঁকি দিতেই অনলাইন নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা ও গুজব মোকাবিলায় সামাজিক মাধ্যমের সক্ষমতা, ইচ্ছে কিংবা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা এবং অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। এমন মুহূর্তে কম্পিউটারের একটি পরিভাষা নিয়ে মেতেছে বাংলাদেশ। অনলাইন-অফলানই সব মাধ্যমই ঘুরছে ‘রিসেট’ শব্দটি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৩৬ জুলাইয়ের ‘বাক-স্বাধীনতা’ ফিরে পাওয়ার পর ভারসাম্যহীনভাবেই যেন এই শব্দটি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে এক সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারে ‘ছাত্ররা রিসেট বাটন’ চাপ দিয়েছে বলে মন্তব্য করার পর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। পরবর্তী সময়ে এই মন্তব্যে ঘি ঢালেন ‘নতুন বাংলাদেশ’ রূপান্তরের যাত্রার দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন আইন প্রয়োগ ও বিচারিক দায়িত্বপালনকারী একজন উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় কর্মচারী।
তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি নামের এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন জনরোষে পতিত সরকারের সময়ে। সেই সরকারের প্রধান যখন প্রতিবেশী দেশে ভারতে অবস্থান করছেন, সেই দেশটিরই একটি জেলা কোচ বিহারের লাগোয়া বাংলাদেশের লালমনিরহাটের বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু সেই নজরদারিত্বের তাপস্যা নিয়ে নয় ঊর্মি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন সদ্য দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে। সরকারি চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে তিনি লেখেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।’
ফেসবুকে লেখা তার এই স্ট্যাটাসটি মুহূর্তে সাগরের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে ফেসবুকের শেয়ার-কমেন্টে। যথারীতি প্লাবিত হয় নেটদুনিয়া। নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ঊর্মি লিখেছিলেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ! কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়।’
এটাতো তার ব্যক্তিগত পোস্ট। ফিরে পাওয়া বাক-স্বাধীনতার এই দেশে তিনি তো লিখতেই পারেন। তাতে এত হৈ চৈ কেন? সাদা মনের এই সরল বয়ান কিন্তু ততটা গরল হয়ে ওঠে যখন বিষয়টা ‘বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ’ রূপ নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসক বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমে ক্লোজড এবং পরে আদালতের সমন আছে। এতে সামনে আসে অনেকগুলো প্রশ্ন, সন্দেহ। কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসে সাপ!
বস্তুত, সরকারি চাকরিজীবীদের ৭৯–এর কন্ডাক্ট রুল অনুযায়ী আচরণ করতে হয়। সেখানে ২৩ এর এ উপধারা অনুযায়ী জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ককে ইফেক্ট করতে পারে সরকারের এমন সমালোচনা পারেন না একজন সরকারি কর্মী। তাহলে এই চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে কেন তাহলে তিনি এমনটা লিখলেন? তিনি কি এটা জানতেন না? বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার বক্তব্য পড়ে বিষয়টি অবশ্য পরিষ্কার হওয়া গেছে। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় ঊর্মি বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যেকোনো জায়গা থেকে বলা যায়। এ জন্য যদি চাকরি চলে যায়, এতে আমার কোনো সমস্যা নাই।’
কীভাবে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এমন মন্তব্য করেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি যখন দেখব, আমার দেশের ওপর কোনো থ্রেট চলে আসছে, দেশকে বাঁচানোর জন্য আমার যতটুকু বলা উচিত, সেই বলাটাই আমার দায়িত্বশীলতা। আমি ফ্র্যাংকলি বলি, আমি চাই না আমার দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি আসুক। আমার যাকে মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, আমি তাদের সেভাবেই ট্রিট করেছি এবং সেভাবেই পোস্ট দিয়েছি।’
তবে কোথা থেকে কী ধরনের থ্রেট পেয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বলতে তিনি কাদেরকে বোঝাচ্ছেন তা তিনি খোলাসা করেননি। তবে খবরে প্রকাশ, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ঊর্মি। তিনি ঠিক করেছেন বিদেশে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন। সেজন্য ১ সেপ্টেম্বর রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার থেকে পাসপোর্টের জন্য এনওসি নেন তিনি। সম্প্রতি তিনি ‘হায়ার স্টাডি অ্যাবরোড’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে তাকে যুক্ত হতে দেখা যায়।
অভিযোগ উঠেছে, দ্রুত চাকরি থেকে বের হওয়ার পাশাপাশি বাইরে ভিসা পাওয়া কিংবা প্রয়োজনে অ্যাসাইলাম পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে ঊর্মিকে একটু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রথমে জনরোষ তৈরি করতে তিনি আবু সাইদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল লক থাকায় সেটা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কিন্তু এবার প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে তার পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর তার বক্তব্য আরও সংশয়ের জন্ম দেয়। দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে কী লেখা যায় কিংবা যায় না তার তোয়াক্কা না করে তিনি সংশয় ছড়িয়ে বলেছেন ‘এর জন্য যদি আমার চাকরি চলে যায়, সমস্যা নেই। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, এটা মীমাংসিত সত্য। রিসেট বাটন মুছে ফেলে অতীত মুছে ফেলা, এর মানে কি? তাহলে তো আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধেরবিরোধী শক্তি আমাদের দেশে সরকার হিসেবে আছে। আমার মনে হয়েছে, আমার দায়িত্বশীল জায়গা এটাই। বলা হচ্ছে জুলাই গণহত্যা, এগুলো সবই তদন্তসাপেক্ষ, মীমাংসিত সত্য না। এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি তো।’
আসলে প্রযুক্তির এই ‘ভাইরাল’ পরিভাষার মতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া ‘রিসেট’ শব্দটিও যেন এখন ভুল-ভাল ব্যবহার হচ্ছে। কেননা, কম্পিউটারের রিসেট করার আগে আরও যে দু’টি ধাপ আছে, তা বেমালুম আড়ালে গেছে। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও অবশ্য সেই রিফ্রেশ ও রিস্টার্ট পাঠটি পার করেছে গোটা জাতি। সেই ধাপগুলোতে দেশে সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি বেড়েছে, স্তুতির সঙ্গে সঙ্গে বাক-স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ হয়েছে। তারুণ্যের শক্তিতে বার্ধক্যের উর্দি পরিহিতরাও সুশানের জন্য উসখুস হয়ে রিসেট বাটন চাপতে সঙ্গী হয়েছেন। সেই যাত্রায় সময়ই যেনো ঊর্মিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালো আজ। তবে এ সময় ‘গুজব’ বা ভুল-ভাল ব্যখ্যা বা ইমোশনকে ধরে রাখতে হবে আমাদের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সময়ে পরিভাষাকে পাঠে সচেতন হতে হবে। কেননা, রিসেট করা মানেই মুছে ফেলা নয়। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে যেমন মানুষে ‘পুণর্জন্ম’ হয়। তেমনি হার্ডওয়্যার না বদলেই ‘সফটওয়্যার’ আপডেটের সময় স্বয়ংক্রিয় নিয়মেই ডিভাইস ‘রিসেট’ করতে হয়।
প্রযুক্তিতেও ডিলিট চেপেই কোনো কিছুই মুছে ফেলা যায় না। ভুলক্রমে মুছে গেলে তা রিকভার করা যায়। আমাদের প্রত্যাশ থাকবে এই ‘রিসেট’ পরবর্তী সময়ে দেশে সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্জীবন পাবে এবং কোটি মানুষের হৃত ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার ফিরে আসবে। ধ্বংসের আগে জীবনের পরিভাষা পড়তে শিখবেন জনতা ও শাসক উভয়েই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজি বাংলা।
সারাবাংলা/পিটিএম