Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খবর প্রচারে নেই অনুমতি, বিজ্ঞাপন খরায় আইপি টিভি

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৭ অক্টোবর ২০২৪ ২২:১১

ঢাকা: ‘খবর প্রচার না করার’ শর্তে ইন্টারনেট প্রোটোকল (আইপি) টিভির নিবন্ধন দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। আর এই শর্তের কারণে শুরু থেকেই দর্শক টানতে পারছিল না আইপি টিভিগুলো। ফলে বিজ্ঞাপন খরায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

বর্তমানে দেশ চালাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেজন্য স্যাটেলাইট টেলিভিশনের চাপে বৈষম্যমূলক ওই শর্ত জুড়ে দেওয়ার অভিযোগটি নতুন করে সামনে এসেছে। ‘সংবিধান বিরোধী’ ওই শর্ত উঠিয়ে খবর প্রচারের অনুমতি ও নীতিমালা সংস্কার করে আইপি টিভিগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন একাধিক আইপি টিভির মালিক।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ২০২১ সালে সরকার ১৪টি আইপি টিভিকে অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে অনেকগুলো টিভি সম্প্রচারে পুরোপুরি সক্রিয় নয়। অনেকগুলোতে বিজ্ঞাপন খরা চলছে। আবার কিছু কিছু টিভির অনুষ্ঠানও নিম্নমানের। পুরোনো বাংলা সিনেমা প্রচার করে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম সচল রেখেছে।

অনুমোদনপ্রাপ্ত ১৪ আইপি টিভি হলো- মুভিবাংলা টিভি, জাগরণ টিভি, রূপসীবাংলা টিভি, হার্নেট টিভি, মাটি এন্টারটেইনমেন্ট টিভি, ফ্লিক্সআরকে টিভি, রাজধানী টিভি, ভয়েস টিভি, জেএটিভিবিডি, নিউজ ২১ বাংলা টিভি, জাগরণী টিভি, শোবাইপ্রাইম টিভি, দেশবন্ধু টিভি এবং সিএইচডিনিউজ ২৪ টিভি।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব আইপি টিভি ওনারস (আইটো)-এর সহ-সভাপতি ও রাজধানী টিভির স্বত্বাধিকারী এমএএস ইমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘খবর প্রচার করতে না পারায় আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নিউজ প্রচারে বাধা রয়েছে। তবে ডকুমেন্টারি প্রচারে বাধা নেই। নিউজ করতে না পারার কারণে দর্শক হারাচ্ছি। অনেকে এটিকে পরিপূর্ণ মিডিয়া-ই মনে করে না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘নতুন সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমরা যাতে নিউজ প্রচার করতে পারি। এখন ইউটিউবেও অনেক ধরনের কন্টেন্ট প্রচার হচ্ছে। সেটিও অনলাইনকেই ব্যবহার করেই। কিন্তু আমরা সরকারের নিবন্ধিত মিডিয়া হয়েও বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়েছি। বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে উনার আলাদা করে বসার কথা। তখন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের প্রস্তাব তুলে ধরব।’

রুপসী বাংলা টিভির আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্যাটেলাইট টিভিগুলোর চাপে নিবন্ধন দেওয়া সময় খবর প্রচার না করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। কারণ তারা মনে করে এতে করে আইপি টিভিগুলো স্যাটেলাইট টিভির সমতুল্য হয়ে যাবে। খবর প্রচার না করতে পারলেও আমাদের প্রতিবেদন বা ডকুমেন্টারি প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিবেদনটি কখন প্রকাশ পাবে, কখন প্রচার হবে, নির্দিষ্ট করে তা দর্শক জানতে পারে না। একটি নির্দিষ্ট সময় আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারি না। কোনো একটি ভালো প্রতিবেদন হাতে এলে তা তখনই প্রকাশ করে দিই। এতে করে আমরা খবরের দর্শক হারাচ্ছি।’

আইপি টিভিগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া সময় স্যাটেলাইট টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো) আপত্তি তুলে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির সাবেক নেতা ও একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু এবং আরও কয়েকজন মালিক আইপি টিভির নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ান। পরে খবর প্রচার না করার শর্তে ১৪টি আইপি টিভির নিবন্ধন দেয় ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব মো. আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এককভাবে শুধু ব্যক্তি মোজাম্মেল বাবুই নয়, অ্যাটকোর সবাই বাধা দিয়েছে- যাতে করে আইপি টিভিতে খবর প্রচার না হয়। মূলত তাদের বাধার কারণেই নীতিমালার সময় এই শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আইপি টিভির প্রত্যেক মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যদি খবর প্রচার করতে না পারি, বিজ্ঞাপনও পাওয়া যায় না, তাহলে আমরা কীভাবে চলব। মূলত খবরের সময় টিভিতে বিজ্ঞাপন বেশি প্রচার হয়ে থাকে। ফলে আমরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইপি টিভির এক মালিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমে কী প্রচার হবে, কী প্রচার হবে না- লিখিত নির্দেশনার মাধ্যমে কোনো সরকার তা দিতে পারে না। কিন্তু আইপি টিভির অনুমোদন দেওয়ার সময় বিগত সরকার খবর প্রচার না করার শর্ত জুড়ে দেয়, যা সংবিধান সম্মত নয়।‘

তিনি বলেন, ‘যখন লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছিল তখন আইপি টিভির মালিকরা বিয়ষটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি। তখন আমি তাদের বলেছিলাম; খবর প্রচার করা যাবে না- এটি সংবিধান সম্মত নয়। একসময় ঠিকই আমরা খবর প্রচার করতে পারব। তাই আপাতত শুধু লাইসেন্স নিই।’

জানতে চাইলে জেএটিভিবিডি’র মালিক কিবরিয়া চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মূলত দ্বন্দ্বটা শুরু এ কারণে যে, ইন্টারনেট প্রোটোকল টিভি সারাবিশ্বে উন্মুক্ত; কিন্তু স্যাটেলাইট টিভি চাইলেই দেশের বাইরে সম্প্রচার করা যাবে না। ফলে ব্যবসায়িকভাবে স্যাটেলাইট টিভিগুলো মার খাবে। ফলে তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তবে সেটি তারা পেরে ওঠেনি।’

তিনি বলেন, ‘অনেক স্যাটেলাইট টিভি অনলাইনে দেখা যায়, কিন্তু তাদের আইপি টিভির লাইসেন্স নেই, যেটি অবৈধ। সরকার প্রথমে ১৪টি আইপি টিভিকে অনুমোদন দেয়। পরে ১৪টি স্যাটেলাইট টিভিকেও আইপি টিভির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। এছাড়াও দু’টি টিভিকে আইপি টিভির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে যারা ইন্টারনেটে প্রচার চালাচ্ছে তারা অবৈধ।’

আইপি টিভির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে রুপসী বাংলা টিভির আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘স্বল্প পরিসরে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। গুগল প্লে-স্টোরেও আমাদের অ্যাপস রয়েছে। সবমিলিয়ে আমাদের ২৪ থেকে ২৫ হাজার দর্শক রয়েছে। ভালোভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে আমাদের দর্শক কোটিও ছাড়িয়ে যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে ২০০০ সালে আইপি টিভির যাত্র শুরু হয়। তার ২১ বছর পর বাংলাদেশে আইপি টিভি যাত্রা শুরু করে। সারাবিশ্বে আইপি টিভি বলতে ইন্টারনেট ব্রডকাস্ট টেলিভিশন বোঝায়। কিন্তু, আমাদের এখানে বলা হয় ইন্টারনেট প্রটোকল টিভি। আমাদের দেশে আইপি টিভি সম্পর্কে এখনো মানুষের সঠিক কোনো ধারণা নেই।’

আইপি টিভির মালিকদের এসব অভিযোগের বিষয়ে অ্যাটকোর তখনকার নেতাদের সঙ্গে সারাবাংলা কথা বলতে পারেনি। সাবেক নেতাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন। আবার কেউবা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। স্যাটেলাইট টিভির একাধিক মালিককে মুঠোফোনে কল করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এনটিভির প্রতিষ্ঠাতা ও অ্যাটকোর সাবেক সভাপতি মোসাদ্দেক আলী ফালুর সঙ্গে কথা বলেছে সারাবাংলা।

মুঠোফোনে মোসাদ্দেক আলী ফালু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আট বছর দেশের বাইরে ছিলাম। অ্যাটকোর কোনো মিটিংয়ে অংশ নিতে পারিনি। ফলে তখনকার প্রেক্ষাপট বলতে পারব না। তবে কারও ওপরেই এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে সে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার আইপি টিভিগুলোর কারণে যাতে স্যাটেলাইট টিভি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।’

তবে আইপি টিভি নিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক উপ-সচিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘খবর প্রচার করতে না পারার আইপি টিভির মালিকরা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কোনো দাবি জানাননি। তারা কোনো চিঠিও লিখেননি। বিষয়টি নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার কাছে তাদের দাবি জানাতে হবে। উপদেষ্টা আমাদের নির্দেশ দিলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। আর আইপি টিভিতে খবর প্রচারের বিষয়ে এখনো নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

অনুমতি আইপি টিভি খবর প্রচার বিজ্ঞাপন খরা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর