Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী, কাজ করে যেভাবে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২১ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৫২

ঢাকা: ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন নিষ্পত্তির পর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল করা হয়েছে। এখন সর্বোচ্চ আদালতে কোনও বিচারকের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই কাউন্সিলের নিষ্পত্তি হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

রিভিউ নিষ্পত্তির পর রোববার (২০ অক্টোবর) নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান একথা বলেন।

যেভাবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন:

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়েছিল সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল।
তবে ১৯৭৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছরে সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কার্যকর থাকলেও এই সময়কালে মাত্র একবারই এর প্রয়োগ হয়।

কাউন্সিলের দায়িত্ব সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হল অসদারচণ বা দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, কী হয়নি, তা অনুসন্ধান করা।

তিনি আরও বলেন, উনারা (কাউন্সিলের সদস্য) অভিযোগের প্রাথমিক অনুসসন্ধান করে রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি এটি বিচার-বিবেচনা করে তারপর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফেরত পাঠাবেন। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল তখন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে, এরপর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠাবেন।

তিনি বলেন, এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির।
তবে এখানে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মেকানিক্যাল। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো অসদাচরণ প্রমাণিত হয়েছে কি না, এটাসহ সুপারিশ পাঠানোর।

বিজ্ঞাপন

মাত্র একবার প্রয়োগ হয়:

১৯৭৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কার্যকর থাকলেও এই সময়কালে মাত্র একবারই তার প্রয়োগ হয়েছিল।

সংবিধানের ৯৬ (৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের যে দুই ধরনের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বি বি রায় চৌধুরী ও বিচারপতি এ এম মাহমুদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল প্রথমবারের মতো একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৩৯টি আচরণবিধি নির্ধারণ করে।

এরমধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে।

২০০৩ সালের অক্টোবরে আইনজীবীদের এক সমাবেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘পেশাগত অসদাচরণের’ এ অভিযোগ আনেন। পরে এ অভিযোগ তদন্ত করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তদন্ত শেষে কাউন্সিল শাহিদুর রহমানকে অপসারণের সুপারিশ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রতিবেদন দেয়।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওই সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতির পদ থেকে শাহিদুর রহমানকে অপসারণের আদেশ দেন। ওই দিন তাকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

পরে রাষ্ট্রপতির ওই অপসারণের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান শাহিদুর রহমান। ২০০৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শাহিদুরের অপসারণের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

বিজ্ঞাপন

এরপর হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান। আপিল বিভাগে আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। শাহিদুর রহমান নিজের পক্ষে শুনানি করেন।

এরপর ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে রাষ্ট্রপতির অপসারণ আদেশ বহাল রাখেন।

এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায় এবং রাষ্ট্রপতির কাছে এই বিচারপতির অপসারণের সুপারিশ করে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি শাহিদুরকে ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি অপসারণ করেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বাতিলের আগে সংবিধানের এ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (২) অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোনো বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।

(৩) একটি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাঁহাদের লইয়া গঠিত হইবে:

তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কার্য করিতে অসমর্থ্য হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাঁহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন।

(৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবে-

(ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা; এবং

(খ) কোনো বিচারকের অথবা কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাঁহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোনো পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা।

(৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোনো বিচারক-

(ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা

(খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

(৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।

(৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।

১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল তবে ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে। মার্শাল প্রক্লেমেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদকে। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৯ নভেম্বর এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

রুল শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।

রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। পরে একই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে।

রোববার সেই রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায় বহাল রইলো। একইসঙ্গে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে পুর্নবহাল করা হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল।

সারাবাংলা/কেআইএফ/এমপি

আইন-আদালত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর