প্রশাসনে অস্থিরতা কাটেনি, নতুন আতঙ্ক মামলা
২১ অক্টোবর ২০২৪ ২২:২৬
ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রশাসনে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, বদলি এবং বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার পর এখন নতুন আতঙ্ক মামলা।
জনপ্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকের নামে এর মধ্যেই মামলা হয়েছে। আর এসবের বেশিরভাগই হত্যা মামলা। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু ঢালাওভাবে মামলা করা ঠিক নয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করে ভারতে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ দেওয়া ১১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয় একদিনে। এর পর শুরু হয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল। সেই রদবদলে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক অবসরে, আবার কিছু কর্মকর্তাকে করা হয় ওএসডি। অনেককে বদলি করে অন্যত্রও পাঠানো হয়।
সংস্কারের অংশ হিসেবে পরিবর্তন আনা হয় মাঠ প্রশাসনেও। দুই দিনে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৫১ জেলায় নতুন করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হন নিয়োগবঞ্চিত কিছু কর্মকর্তা। উপ-সচিব পর্যায়ের ওই সকল কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে তাৎক্ষণিক আট জেলার ডিসি নিয়োগ বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। এমনকি ওই ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুই যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের অভিযোগও ওঠে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শেষ পর্যন্ত ওই অভিযোগ প্রমাণ করা না গেলেও অভিযুক্ত দুই যুগ্ম সচিবকেই বদলি করা হয়।
এ ছাড়া সকালে নিয়োগ দিয়ে বিকেলে তা বাতিলের ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে নতুন আতঙ্ক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা। এরই মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ মুখ্য সচিবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকি দু’জন আত্মগোপনে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ ও নজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। অন্য দুই মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং আহমেদ কায়কাউস। এদের মধ্যে একজন দেশের বাইরে, অন্যজন আত্মগোপনে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা দুই মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তারাও গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। সদ্যবিদায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের নামেও হত্যা মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়াও বেশ কয়েকজন সচিবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুই মাসে বেশ কয়েকজন সচিবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাদের নামেও মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও একই মন্ত্রণালয়ের আরেক সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ গ্রেফতার হয়েছেন। মামলা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও ফয়েজ আহমেদ এবং সাবেক সচিব আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধেও। আর এসবের বেশিরভাগই হত্যা মামলা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার নামে প্রতারণার মামলা দেওয়া হয়েছে। যে এলাকায় আমার নামে মামলা হয়েছে, সেখানে আমি কখনো যাই-ই-নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি তো কোনো রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলাম না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভয়ে আছি কখন আবার আমার নামে মামলা দিয়ে দেয়। এখন তো অপরাধ করার দরকার হচ্ছে না। এমনিতেই মামলা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা অপরাধ করেছেন, নিয়ম ভঙ্গ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু এভাবে ঢালাও মামলা ঠিক নয়।’
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রায় ডজন খানেক কর্মকর্তা সচিবালয়ে কাজে যোগ দেননি। এর মধ্যে রয়েছে স্বরাষ্ট্র, খাদ্য, স্থানীয় সরকার, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাজে যোগ না দেওয়ায় তারা আইন অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হবেন।
এগুলোর পাশাপাশি নিজেদের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব রয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বৈষম্য নিরসনের দাবিতে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থাকা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারাও মৌন আন্দোলন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা আলোচনা সভা করছেন তারা। এরই মধ্যে পদোন্নতি, পদায়নসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে তৈরি করা পোস্টার নিজ নিজ ফেসবুক প্রোফাইলে আপলোডের মাধ্যমে কর্মসূচিও পালন করছেন এই ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’র ব্যানারে এ কর্মসূচি পালন করছেন তারা।
সংগঠনটির সমন্বয়কদের পক্ষে মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ১৯ অক্টোবর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন কর্মসূচির রোডম্যাপ করা হয় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে বৈষম্য নিরসনে করণীয় বিষয়ে অবগতের সিদ্ধান্ত হয়। জনবান্ধব সরকার গঠনে সিভিল প্রশাসন পুনর্গঠনের বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া ২০ নভেম্বরের মধ্যে একটি বড় সমাবেশ আয়োজনের দাবি ওঠে ওই আলোচনায়।’
আবার জনপ্রশাসনে দীর্ঘদিনের সুবিধা বঞ্চিতরাও তাদের দাবি নিয়ে সামনে এসেছেন। কোণঠাসা কর্মকর্তারা ভালো পদায়নের প্রত্যাশায় সিনিয়রদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে জনপ্রশাসন বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে কর্মকর্তাদের ভিড় লেগে রয়েছে। পদোন্নতির আবেদনও জমা দিচ্ছেন তারা।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম