৬২ লাখ কিশোরীকে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু আজ
২৪ অক্টোবর ২০২৪ ০০:০৫
ঢাকা: ঢাকা বিভাগের বাইরে দেশের সাতটি বিভাগে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) থেকে শুরু হতে যাচ্ছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধি ভ্যাকসিন প্রয়োগ। বিনামূল্যে এক ডোজ হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) ভ্যাকসিন দেওয়া হবে ৬২ লাখ কিশোরীকে।
দেশের সাত বিভাগে স্কুলের পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রী এবং স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের বিনা মূল্যে এ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন চলবে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার আমাদের ৬২ লাখ ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা আছে। এ কার্যক্রম চলবে ১৮ দিনব্যাপী। এখন পর্যন্ত আট লাখের বেশি রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে। এটা আরও বেড়ে যাবে।‘
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যেহেতু বিভাগীয় পর্যায়ে গত বছর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তাই আমরা এবার বাকি সাতটা বিভাগে ভ্যাকসিন দেবো। সাত বিভাগের ৫১টি জেলায় এ কার্যক্রম চলবে। এই কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিটি কমিটিতে দুজন করে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
ইপিআই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছর দেশে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে বিনা মূল্যে এইচপিভি ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে শুধু ঢাকা বিভাগে এ কার্যক্রম চলেছিল। এ বছর অন্তত ৯৫ শতাংশ কিশোরীকে এইচপিভি ভ্যাকসিনের আওতাভুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
ইপিআইয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৬-১৭ সালে এইচপিডি টিকাদান কার্যক্রমের পাইলটিং হিসেবে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া, শ্রীপুর উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশন জোন-১ এর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ও ১০ বছর বয়সী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত কিশোরীদের এইচপিভি ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়।
প্রথম ধাপে ঢাকা বিভাগে ২০২৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে যেখানে প্রায় ২০ লাখ কিশোরীর মধ্যে ১৫ লাখ ৮ হাজার ১৮৩ কিশোরীকে ১ ডোজ এইচপিভি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, যা উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৫ শতাংশ।
এবার বাকি সাত বিভাগে মোট ৬২ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ কিশোরীকে ভ্যাকসিন দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্কুলের বাইরে থাকা এক লাখ ৮৬ হাজার ৬৭৬ কিশোরীকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। ঢাকা বিভাগের অভিজ্ঞতার আলোকে অবশিষ্ট সাতটি বিভাগে অক্টোবর-নভেম্বের ২০২৪ সালে এইচপিভি ক্যাম্পেইন শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানায় ইপিআই কর্মকর্তারা।
এইচপিভি কী?
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) একটি যৌনবাহিত ভাইরাস। এটি জননাঙ্গে আঁচিল (ওয়ার্টস) ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে। আজ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া শতাধিক ধরনের এইচপিভি ভাইরাসের মধ্যে প্রায় ১৩টি সেরোটাইপ ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে। তার মধ্যে ১৬ এবং ১৮ সেরোটাইপ খুবই মারাত্মক, যা ৭০% জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। শতকরা ৯৯ ভাগ জরায়ুমুখ ক্যান্সার এইচপিভি ভাইরাস দ্বারা হয়।
এইচপিভি ছড়ায় যেভাবে
অনিরাপদ শারীরিক মিলনের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। সাধারণত এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়া থেকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৫-২০ বছর সময় লাগে। তবে স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন নারীদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রূপ নিতে মাত্র ৫-১০ বছর সময় লাগে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত এবং দেহরসে এই ভাইরাস পাওয়া যায়।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ
অতিরিক্ত সাদা স্রাব, অতিরিক্ত অথবা অনিয়মিত রক্তস্রাব, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় রক্তপাত, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, শারীরিক মিলনের পর রক্তপাত ও কোমর/তলপেট/উরুতে ব্যথা।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অধিক ঝুঁকিতে যারা
বাল্যবিবাহ, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, অনিরাপদ শারীরিক মিলন। একাধিক যৌনসঙ্গী, ধূমপায়ী, স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী (যেমন—এইডস রোগী) এবং যে সকল নারী প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন নন এবং সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের অথবা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নেন না, তাদের এই ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এইচপিভি ভ্যাকসিন পেতে নিবন্ধন যেভাবে
এইচপিভি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য https://vaxepi.gov.bd/registration ওয়েবসাইটে গিয়ে ১৭ ডিজিটের অনলাইন জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। তবে যাদের অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ নেই, তাদেরও বিশেষভাবে তালিকাভুক্ত করে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
এ ছাড়া শুরুতে এ কার্যক্রম সাতটি বিভাগের নির্দিষ্ট বয়সী ও নির্ধারিত শ্রেণীতে অধ্যয়নরত কিশোরীরা www.vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে ভ্যাকসিনকার্ড সংগ্রহ করতে পারবেন। পরে ওই কার্ড দেখিয়ে ভ্যাকসিনের ডোজ গ্রহণ করা যাবে।
এইচপিভিতে বছরে ৫ হাজার নারীর মৃত্যু, প্রতিরোধে জরুরি ভ্যাকসিন
দেশে প্রতিবছর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় ৫ হাজার নারী মারা যান। আর প্রতিবছর লাখে ১১ জন নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সে হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। দেশে নারীরা যত ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হচ্ছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হালনাগাদ সুপারিশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে এক ডোজ ভ্যাকসিনই কার্যকর। এ ক্যান্সারে প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ৯০ শতাংশকে ভ্যাকসিন, ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে অন্তত দুবার স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা এবং ৯০ শতাংশকে চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য রয়েছে।
সারাবাংলা/এসবি/এইচআই