Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাবি মেডিক্যালের নাজুক হাল, ‘বাধ্যতামূলক’ যেখানে প্যারাসিটামল

আরফাতুল ইসলাম নাইম, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
২৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০৫

ঢাকা: প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস নির্মাণের সূতিকাগার হলেও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একমাত্র মেডিক্যালটির অবস্থা বড়ই নাজুক। তাই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নামে এখানে চলে মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের প্রহসন। ঢাবির শহীদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টারের ভগ্নদশার পাশাপাশি ওষুধের স্বল্পতা, যন্ত্রপাতির ঘাটতি ও চিকিৎসকদের কাজে ফাঁকি দেওয়াসহ নানান অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

সরজমিনে দেখা যায়, ঢাবি মেডিক্যালের বর্তমান নাজুক হাল। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে ভবন। দরজা-জানালাগুলোরও বেহাল দশা। এমনকি বৃষ্টিতে পানিও চুইয়ে পড়ে। ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

দেখা গেছে, ঢাবির শহীদ মোর্তজা মেডিক্যালে যেকোনো রোগের প্রতিষেধক হিসেবে প্যারাসিটামল যেন বাধ্যতামূলক। প্রতিদিন ঢাবির এই মেডিক্যালে গড়ে ৪০০-৪৫০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। যাদের প্রেসক্রিপশন চেক করলে দেখা যায়, প্রতি ২০ জনে অন্তত ১৮ জনকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘হয়েছে চুলকানি, আমাকে দিলো নাপা। শুধু তাই নয়, ডাক্তার অন্তত একবারের জন্য আমার সেই রোগাক্রান্ত জায়গাটা দেখেননি। আমার মুখ থেকে শুনে ওষুধ দিয়েছেন।’

এমন ঘটনা শুধুমাত্র একজনের ক্ষেত্রে নয়, প্রতিদিন যে সকল রোগী ঢাবি মেডিক্যালে যান তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এমনকি চিকিৎসক মেডিক্যালে না দেখে নিজের চেম্বারে যোগাযোগ করতে বলেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দ্বিতীয় তলায় জরুরি বিভাগ, ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

সাধারণত প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে নিচ তলায় জরুরি বিভাগ থাকে। তবে ভালো লিফট বা ওঠার ব্যবস্থা থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ঢাবির শহীদ মোর্তজা মেডিক্যালের চিত্র এবেবারেই ভিন্ন। ভালো ট্রলি কিংবা লিফট সুবিধা না থাকার পরও জরুরি বিভাগ বানিয়েছে দ্বিতীয় তলায়। ফলে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি কয়েকদিন আগে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। পরে আমার বন্ধু আমাকে ঢাবি মেডিক্যাল নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে আমাকে দ্বিতীয় তলায় তুলতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে বাধ্য হয়।’

বিজ্ঞাপন

নেই ডিজিটাল মেশিন, ম্যানুয়েল থাকলেও চলছে না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোর্তজা মেডিক্যালের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাবি মেডিক্যালে কোনো ডিজিটাল মেশিন নেই। এক্সরে মেশিন ম্যানুয়েল হওয়ায় ঠিকমতো পরীক্ষা করা যায় না।

তিনি বলেন, ‘দাঁতের চিকিৎসার জন্য ভালো কোনো যন্ত্রপাতি নেই। এমনকি স্ক্যালিং সিস্টেম , প্রোপোটিং গ্যাপ ভরাট করার জন্য কোনো মেডিসিন নাই। এছাড়াও, কিছুদিন আগে দাঁতের জন্য একটা ওপিজি মেশিন আসার কথা থাকলেও সেটার আর খবর নাই।’ এমনকি জরুরি বিভাগের জন্য কার্ডিয়াক বেডেরও স্বল্পতা আছে বলে জানান তিনি।

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ

সরজমিনে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যালে ১৫০ রকম ওষুধের মধ্যে অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। কয়েকটি প্যাকেট যাচাই করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে সবগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত ওষুধ পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। গত এক সপ্তাহে যারা ডাক্তার দেখিয়েছেন কেউ কোনো ওষুধ পাননি বলে জানা গেছে।

এ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের এক অফিসার সারাবাংলার এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমাদের ওষুধের স্টোর রুমের অবস্থা খারাপ। সেখানে ঢোকা যায় না। আর, সেটার যা অবস্থা সেখানে ভালো ওষুধও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।’

এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘সেবার মান নিয়ে কথা বলার রুচি নেই। এ মেডিক্যালে কখনো ভালো সেবা তো পাই নাই, সরকারি ওষুধেরও স্বল্পতা আছে।

কাজে ফাঁকির অভিযোগ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যালের ডাক্তারদের নিয়ে অভিযোগের যেন শেষ নেই। সেখানে বর্তমানে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ১০ জন, দাঁতের ডাক্তার দুই জন, চোখের একজন, প্যাথোলজিস্ট একজন, নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ একজন (অনিয়মিত), কার্ডিওলোজিস্ট একজন ও পাঁচজন হোমিও ডাক্তারসহ ২১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কাজে ফাঁকি দেওয়া, রোগী না দেখা ও অফিস ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ঢাবি মেডিক্যাল সুত্রে জানা গেছে, শাফফাত হোসেন জামি, সায়েদ আলী আনহা, আরিফুর রেজা সিকদার, সাজ্জাদ হোসেন ও দন্ত বিশেষজ্ঞ রতীন্দ্রনাথ সরকারসহ (রবিন) বেশ কয়েকজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে যে, তারা ঠিক মতো রোগী দেখেন না। এমনকি তারা নিয়মিত ছয় ঘণ্টার ডিউটি দুই ঘণ্টা করে চলে যানও বলে অভিযোগ এসেছে।

এদিকে, ডা. শাফফাত হোসেন জামির মোবাইলের একটি স্ক্রিনশট সারাবাংলার হাতে এসেছে। যেখানে তিনি বলছেন, ’আমাকে স্কিনের রোগী পাঠাবেন না। আমার সাধারণ রোগী ও স্কিনের রোগীও দেখা লাগে। যেটা আমার ওপর চাপ যায়। অথচ, তিনি স্কিনের ডাক্তার ।’

এ বিষয়ে ঢাবি শিক্ষার্থী বুসরা জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাবি মেডিক্যালের ডাক্তারদের আচরণ ভালো না।বিশেষ করে, মহিলা ডাক্তাররা মেডিসিন না দিয়ে মোটিভেশান স্পিচ দিয়ে পাঠিয়ে দিই। রোগী বসে আছে তাও তাদের দেখি গল্প করছে এমন অবস্থা।’

ঢাবি শিক্ষার্থী জুলিয়া আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নারী ডাক্তার যিনি, ওনার বিহেভিয়ার দেখলেই বমি পায়। কিছু ভালো করে শোনার আগেই ওনার মতো বকবক করে যায়। সবসময় অ্যাগ্রেসিভ হয়ে কথা বলে।’

ঢাবি শিক্ষার্থী তাহিয়া তাসনিম মীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অভিজ্ঞ নার্স দরকার। ফ্রেন্ডের চারটা সেলাই দেওয়া হাত নিয়ে গেছিলাম ড্রেসিং করার জন্য। ওখানে যে ইনফেকশন হয়ে গেছে সেটা নার্স আইডেন্টিফাই-ই করতে পারেনি। কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে নিজেদের সন্দেহ হওয়ায় পিজিতে গিয়ে দেখাই। এরপর ইনফেকশন শনাক্ত করে ওরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।’

ঢাবির অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আহসান হাবিব আসিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাই ডাক্তারই তো মানসম্মত নয়, বাকি হিসাব তো পরে। এখানে আগে ভালো ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া উচিত। এর পর বাকি হিসাব।’

এ সব বিষয়ে পরিকল্পনা আছে জানতে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ডা. সাইমা হক বিদিশার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তার সাড়া মিলেনি।’

তবে ঢাবি উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে একটা কমিটি গঠন করেছি। তারা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আমরা আশা করি, আমাদের যতটুকু রিসোর্স আছে তা দিয়ে কিছুটা পরিবর্তন আনা যাবে।’

সারাবাংলা/এআইএন/পিটিএম

নাজুক হাল নাপা শহীদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর