Thursday 02 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ— নব্বইয়ের আদলে জাতীয় ঐকমত্যের তাগিদ

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৪ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:২৭ | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:৫৩

গত বছরের ২৪ এপ্রিল ওই সময়কার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। ছবি: পিআইডি

ঢাকা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে কথা বলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। খোদ রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনের সামনে টানা দুই দিন চলেছে বিক্ষোভ। যাদের নেতৃত্বে সরকার পতনের আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রীতিমতো রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে আলটিমেটাম পর্যন্ত দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি করেছে।

বিজ্ঞাপন

সব কিছু মিলিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই সবার মুখে একই প্রশ্ন— রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন কি পদত্যাগ করবেন? নাকি তাকে অপসারণ করা হবে?

এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সাংবিধানিক সংকটের কথাও। রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? কিংবা রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে হলেই বা সংসদের অবর্তমানে সেই প্রক্রিয়াটি কী হবে? রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে বা রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে তার অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করবেন কে? নতুন রাষ্ট্রপতিই বা নির্বাচন করা হবে কীভাবে?

আরও পড়ুন- রাষ্ট্রপতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে

এসব প্রশ্ন ঘিরে নানা ধরনের মতামতের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে সিদ্ধান্ত হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বলছেন একই কথা। তবে কেবল রাজনৈতিক দল নয়, তারা রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন। আর উদাহরণ হিসেবে টেনে আনছেন ১৯৯০ সালের কথা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকার পতনের পর যখন প্রধান বিচারপতির পদে থাকা প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে ঘিরে বিতর্কের সূত্রপাত দৈনিক মানবজমিনের ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখে’ প্রকাশিত প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে মতিউর রহমান চৌধুরী লিখেছেন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারের কোনো দফতরেই শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নেই। খোদ রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন, তার কাছেও পদত্যাগপত্র বা এর অনুলিপি নেই, নেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও।

বিজ্ঞাপন

বিতর্কের কারণ হলো— ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি প্রথমবার যখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

আরও পড়ুন- রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে কি?

পরে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গণমাধ্যমে বলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। সাংবিধানিকভাবে তিনিই এখনো বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রী। একই দাবি পরে আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও করেছেন। এমনকি শেখ হাসিনার দুয়েকটি ফোনকল রেকর্ড ফাঁস হলে সেখানেও তাকে বলতে শোনা যায়, তিনি পদত্যাগ করেননি।

এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি যখন মানবজমিন সম্পাদককে বলেন যে তার কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নেই, স্বাভাবিকভাবেই তার বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। সেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সরকারও। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার ও শপথভঙ্গ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, সরকার আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে একমত।

রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ঐকমত্য তৈরির দিকেই তাগিদ দিচ্ছেন। পাশাপাশি এ দিকটিতেও তারা মনোযোগ রাখতে বলছেন, সাংবিধানিক সংকট যেন না হয়। এ ইস্যু ঘিরে যেন আবার বিভক্তি না ঘিরে ধরে।

আরও পড়ুন- প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ২ উপদেষ্টার বৈঠক

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা বা না থাকা আমাদের চাওয়ার বিষয় না। পরিস্থিতি এমনিতেই যথেষ্ট তরল ও সংকটগ্রস্ত। এর মধ্যে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, এটা আমরা চাই না।’

রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বিতর্ক তৈরি করেছে উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রতীক রাষ্ট্রপতি। দুটি নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া তার হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তবে তিনি যা বলেছেন, তার মতো উচ্চতর সম্মানের পদের সঙ্গে সেটি যায় না। কারণ একটি মীমাংসিত প্রশ্নকে তিনি যখন আবার উত্থাপন করেন, সেটি নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হয়। সেটিই হয়েছে।’

পদত্যাগ প্রশ্নে রাষ্ট্রপতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মনে করছেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করবেন নাকি পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন, এ সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। সেটি করলে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে উচ্চ আদালতের রেফারেন্স নিয়ে জাতীয় সমঝোতার মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আরও পড়ুন- ‘প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য স্ববিরোধী’

সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স বলতে মূলত সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের কথা বোঝানো হচ্ছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে আপিল বিভাগে পাঠাতে পারবেন। আপিল বিভাগ নিজ বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর ওই প্রশ্ন সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে মতামত দিতে পারবেন। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান না থাকলেও ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতি সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের পরামর্শ নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও। ১৯৯০ সালে যেভাবে বিচাপতি শাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই উদাহরণও টানলেন তিনি।

মান্না বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের নিয়োগ দেওয়া রাষ্ট্রপতির থাকা উচিত না। তিনি এত বিতর্কিত হয়েছেন যে তার স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া উচিত। তিনি চলে গেলে কোনো সংকটও হবে না। ১৯৯০ সালে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে তিনি ফের প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে গেছেন। রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে পারলে সবই সম্ভব।’

আরও পড়ুন- বঙ্গভবনে ফ্যাসিস্টের দোসর বসে আছে: মাহমুদুর রহমান

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সাংবিধানিক সংকট নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদটি তো আলঙ্কারিক। আবার সংবিধান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান সরকারই তো সাংবিধানিকভাবে হয়নি। কারণ সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধানই নেই। দেশের মানুষ এক হয়েছিল বলেই পরিস্থিতির কারণে আপিল বিভাগের রেফারেন্সে এই সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ইস্যুতেও জাতীয় ঐকমত্য হলে উচ্চ আদালতের রেফারেন্স নিয়ে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো সংকট নেই।’

রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে মনোযোগ না দিয়ে বরং অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ তথা রাষ্ট্র সংস্কারে মনোযোগী হওয়ার কথা বললেন রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, সবাই একমত হলে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের কোনো প্রক্রিয়াতেই কোনো সংকট নেই। রাষ্ট্রপতি পদটির যেহেতু তেমন কোনো ক্ষমতা নেই, ফলে এই পদে কে থাকছেন না থাকছেন সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা চাই রাষ্ট্র সংস্কারের যে কাজগুলো আছে, সরকার সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে করুক।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয় কি না, সে শঙ্কাও করছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো ‘অশুভ শক্তি’ সামনে এগিয়ে আসতে পারে। এসব আশঙ্কাকেও বড় করে দেখছেন না রাজনীতিবিদরা।

আরও পড়ুন – পদত্যাগ করতে রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি কিছুটা অস্থির হলেও এর মধ্য দিয়ে কোনো অশুভ শক্তির ফিরে আসার সুযোগ নেই। অশুভ শক্তি আগে চেষ্টা করেছিল, ব্যার্থ হয়েছে। জনগণ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং তাদের রুখে দেবে।’

সাইফুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ঘিরে কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে কোনো মহল তার সুযোগ নিক, সেটা আমরা চাই না। আমরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়েও এমন কোনো জায়গা তৈরি করতে চাই না যার মাধ্যমে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়।’

এদিকে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকেও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুটি আলোচনায় এসেছিল। বৈঠকের পর পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

আরও পড়ুন- রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাবিতে বিক্ষোভ

কবে নাগাদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বা এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধি কীভাবে অনুসরণ করা হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সরকার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। তাই প্রতিটি বিষয় সংবিধানের আলোকে হবে কি না, তা দেখার বিষয়। আর যেহেতু রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি গণদাবি হয়ে উঠছে, তাই দেরি করার সুযোগ নেই।’

সরকার গুরুত্ব সহকারেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুটি বিবেচনা করছে, তার ইঙ্গিত মঙ্গলবারেও পাওয়া গেছে। ওই দিন বিকেলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং তিনি পদত্যাগ করলে কে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন, সে বিষয়েও আলোচনা হয়।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর