কক্সবাজারের ডিম ‘খাইরুল সিন্ডিকেটে’র হাতে, দাদনে জিম্মি খামারি
২৫ অক্টোবর ২০২৪ ২২:১৩
কক্সবাজার: কক্সবাজার জেলায় খামারি ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কে কত টাকায় ডিম বিক্রি সে সিদ্ধান্ত ওই খামারি বা ব্যবসায়ীরা নয়। বরং আগের দিন মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে সেই দাম নির্ধারণ করে দেন আরেকজন। ওই এসএমএসে নির্ধারিত দামের বাইরে ডিম বিক্রির কোনো সুযোগই নেই খামারি বা পাইকারের।
এদিকে একজন পাইকারি বা খুচরা বিক্রেতা ইচ্ছা করলেই সরাসরি খামারির কাছ থেকে ডিম কিনতে পারেন না। খামারিরাও আটকে রয়েছেন ওই এসএমএস পাঠিয়ে দাম নির্ধারণ করা ব্যক্তির কাছেই। তার কাছে কিংবা তার অনুমতি ছাড়া আর কারও কাছে খামারির ডিম বিক্রির সুযোগ নেই। কারণ তার নিয়ন্ত্রিত ‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেট’ দাদন দিয়ে কব্জা করে রেখেছে খামারিদের।
কক্সবাজারের পাইকারি ও খুচরা ডিম ব্যবসায়ী এবং খামারিদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। তারা বলছেন, কক্সবাজার জেলার ডিমের এই পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ঈদগাঁও উপজেলার লেয়ার খামার মালিক সমিতির নেতা খাইরুল বশর। তিনি নিজেও বাজারে বিক্রির জন্য ডিমের দাম নির্ধারণের কথা স্বীকার করেছেন। তবে বলেছেন, চট্টগ্রামের সিন্ডিকেটের দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলাপ-আলোচনা করেই নির্ধারণ করা হয় ডিমের দাম।
ডিমের বাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপচারিতায় পাওয়া তথ্য বলছে, জেলার শতাধিক খামার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন খাইরুল বশর। তার নিয়ন্ত্রণাধীন সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ১৮৪ জন সদস্য। কক্সবাজার জেলা ছাড়াও চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বান্দরবনের একটি অংশে ডিম সরবরাহ করেন তারা।
গত কয়েক দিন ধরে সারা দেশেই নিত্যপণ্যের বাজারে আলোচিত পণ্য ডিম। নিম্ন আয়ের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের অন্যতম এই উৎসও নাগালের বাইরে চলে যেতে বসেছিল। টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা দেশে বেড়েছে এই পণ্যটির দাম।
কক্সবাজারের বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা দোকানে ডিম বিক্রি হচ্ছে একেকটি ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা এসব ডিম পাইকারি দোকান থেকে কিনছে ১২ টাকা ৭৫ থেকে ১৩ টাকায়। আবার পাইকারি ক্রেতারা এসব ডিম কিনছেন সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১২ টাকায়। ওদিকে খামারিরা ডিম বিক্রি করছেন আরও কম দামে। তাহলে খামারির কাছ থেকে পাইকারি বা খুচরা ক্রেতারা ডিম কিনছেন না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বের হয়ে এলো ডিম সিন্ডিকেটের কথা। পাইকারি ডিম বিক্রেতার পাশাপাশি খামারিরাও এককথায় স্বীকার করে নিয়েছেন, পাইকার ইচ্ছা করলেই খামারির কাছ থেকে ডিম কিনতে পারবেন না। কিংবা খামারিরাও চাইলেই পাইকারদের কাছে সরাসরি ডিম বিক্রি করতে পারবেন না। উভয় পক্ষই জিম্মি সিন্ডিকেটের হাতে।
শুধু তাই নয়, খামারি ও পাইকারদের মধ্যে ডিমের বেচাকেনাই কেবল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে না, দুপক্ষের মধ্যে আর্থিক লেনদেনও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে একই সিন্ডিকেট। দেখা গেছে, আগের রাতে ডিমের চাহিদা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পাইকারি দোকানে ডিম পৌঁছে দিচ্ছেন কোনো না কোনো খামারি। খামারি নিজ খরচেই পাইকারি দোকানে এসব ডিম পৌঁছে দেন। অথচ এই টাকা খামারি সরাসরি গ্রহণ করতে পারেন না। সিন্ডিকেট সদস্যরাই পাইকারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পৌঁছে দেন খামারিকে। মাঝ থেকে রেখে দেন নিজেদের কমিশনও।
খামারি ও পাইকাররা বলছেন, ঈদগাঁও উপজেলার লেয়ার খামার মালিক সমিতির নেতা খাইরুল বশর ডিমের বেচাকেনা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। জেলার খামারিদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রতিদিন মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে পরের দিনের ডিমের দাম নির্ধারণ করে তিনি। আর এই নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে রয়েছে খামারিদের আগেই টাকা দিয়ে রেখেছে খাইরুলের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট।
রামুর জোয়ারিয়া নালা এলাকার এক খামারির কাছে ডিমের দাম জানতে চাইলে তিনি বলতে অস্বীকার করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই খামারি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে ডিম উৎপাদন করলেও ডিমের দাম নির্ধারণ হয় খাইরুল বশরদের নির্দেশে। কারণ তারা আমাদের আগে থেকে টাকা দিয়ে রাখে, সব ডিম কিনে নেয়। ডিম আমাদের, লাভ করে তারা। বাজার অস্থিতিশীল হলে অনেক সময় আমাদের লোকসানও হয়। কিন্তু ওই সময়ও সিন্ডিকেট ঠিকই লাভ করে।’
ডিমের একাধিক পাইকারি বিক্রেতাও বলেন একই কথা। কোন পাইকার কোন খামারির কাছ থেকে ডিম কিনবে, সেই ডিমের কী দাম হবে— সবকিছুই নির্ভর করে সিন্ডিকেটের ওপর। ওই দামে ডিম বেচাকেনা করলে ব্যবসায়ীদের লাভ-ক্ষতি কী হবে না হবে, তা সিন্ডিকেটের বিবেচ্য বিষয় নয়।
এসব বিষয়ে জানতে কথা হয় খাইরুল বশরের সঙ্গে। সারাবাংলার কাছে তিনি স্বীকার করে নেন, প্রতিদিনিই কক্সবাজারে ডিমের দাম নির্ধারণ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মোবাইলে এসএসএস পাঠান তিনি। খামারিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণের কথাও স্বীকার করেন। তবে মূলত খামারিদের সহায়তা করতেই তাদের টাকা দেন বলে জানান তিনি।
ডিমের দাম কীসের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করেন— এমন প্রশ্নের জবাবে খাইরুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ইচ্ছামতো ডিমের দাম নির্ধারণ হয় না। এই দাম নির্ধারণ হয় চট্টগ্রামের ডিমের পাইকারি বাজার থেকে। ওখান থেকে দেওয়া দাম অনুযায়ী এখানকার ডিমের দাম নির্ধারণ হয়।’
খাইরুল আরও বলেন, ‘কক্সবাজারে উৎপাদিত ডিম স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামের বাজারে পাঠানো হয়। এ কারণেই মূলত চট্টগ্রাম থেকে যে দাম দেওয়া হয়, আমাদের সেই দামই মেনে নিতে হয়। প্রতিযোগিতার এই বাজারে টিকে থাকতে হলে এর বিকল্প নেই।’
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রশাসন বরাবরই মাঠে বলে দাবি করা হচ্ছে। সবশেষ গত সোমবার (২১ অক্টোবর) জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে ডিমের সিন্ডিকেটও উঠে আসে আলোচনায়।
বৈঠকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, ‘নতুন সরকারের কার্যক্রমের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূলের নিয়ন্ত্রণ। তাই কোনো অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট বাজার পরিস্থিতি অস্থির করে তুললে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে আন্তরিকভাবে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করতে হবে।’
সারাবাংলা/টিআর
কক্সবাজার কক্সবাজারের ডিম খাইরুল সিন্ডিকেট ডিম ডিম সিন্ডিকেট ডিমের বাজার