যে কারণে বারবার লাইনচ্যুত হচ্ছে ট্রেন
২৬ অক্টোবর ২০২৪ ২২:২৩
ঢাকা: ২৪ অক্টোবর রাতে ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’র ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয় কমলাপুর স্টেশনের কাছে। সেগুলো উদ্ধার করতে সময় লেগে যায় প্রায় ১৩ ঘণ্টা। আর এই ১৩ ঘণ্টা সারাদেশের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার রেলযোগাযোগ বন্ধ ছিল। এর আগে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী ‘ব্রক্ষ্মপুত্র এক্সপ্রেস’ লাইনচ্যুত হয় গত ১ অক্টোবর। ২৩ অক্টোবর চুয়াডাঙায় তেলবাহী ট্যাঙ্কার লাইনচ্যুত হয়ে দীর্ঘ সময় খুলনার সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ বন্ধ থাকে। ২৪ অক্টোবর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ট্রেন লাইনচ্যুত হলে বন্ধ থাকে ভাঙা-ঢাকা ট্রেন চলাচল।
বাংলাদেশ রেলওয়ে বলছে, শুধু অক্টোবর মাসের ২৫দিনেই ১২টির বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য জনবল সংকটকে দায়ী করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পু্রোনো লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন আর রক্ষণাবেক্ষণই এর জন্য দায়ী।
রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ৯৪৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করেছে। এসব রেলপথে আড়াই হাজার অর্থাৎ ২ হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং আছে। সে হিসেবে রেললাইনের প্রায় প্রতি কিলোমিটারে একটা করে লেভেল ক্রসিং থাকার কথা। আর এসব রেল ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশে কোনো গেট নেই বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ট্রেন চলাচলে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই বগি ও ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে। এ ছাড়া অপারেশন ঘাটতির বিষয়টিও দুর্ঘটনার অনুসন্ধানে সামনে এসেছে। যোগাযোগ ও দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণও এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে রেললাইনের ভিত ঠিক থাকে না। ভিতের লেভেল ঠিক রাখার জন্য লাইনের নিচে যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো যথাসময়ে পরিবর্তন করা হয় না। যেগুলো প্রায় জোড়া তালি দিয়ে রাখা হয়। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। লেভেল ক্রসিংও অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ।’
তার কথার সঙ্গে একমত খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়েতে কাজ করে আসা সাবেক এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মূলত পুরোনো লাইন, দুর্বল রেল, কম স্লিপার, লাইনের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক না থাকা, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর ও ফিস প্লেট না থাকা; সর্বোপরি দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বগি লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রেললাইনে সিগন্যাল ত্রুটিও রয়েছে। আবার ভুল সিগন্যাল দেওয়াও ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণ। অনেকসময় চালক সিগন্যাল অমান্য করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এগুলো নিয়ে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু কিছু অসাধু কর্মকর্তার গাফলতির কারণে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়নি।’
রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রেল ইঞ্জিনের সংখ্যা ছিল ৪৪২টির মতো। বর্তমানে এই সংখ্যা ২৬৩টি। এই ইঞ্জিনের মধ্যে ১৮০টি অর্থাৎ প্রায় ৬৭ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। ৫৪ বছরের পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় ইঞ্জিন দিয়েও চলছে রেল। এতে প্রতি বছর দুর্ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে ট্রেনের গতি।
এই গতি টেনে তুলতে এক সময় সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা রেল বিভাগকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সড়ক যোগাযোগ থেকে আলাদা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করে। নতুন মন্ত্রণালয় গঠনের পর থেকে গত ১২ বছরে রেলের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পও নেওয়া হয় বেশিকিছু। যার অধিকাংশই ছিল অবকাঠামো খাতে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন লাইন নির্মাণ ও লোকমোটিভ কেনার দিকেও সরকারের নজর ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের পাশাপাশি যদি পুরনো লাইন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হতো তাহলে আজ এত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের রেল যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলছে না। বর্তমানে যারা রেল পরিচালনা করছেন, তারা সরকারের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকার রেলকে বেহিসাবি টাকা দিচ্ছে, বড় বড় প্রকল্প দিচ্ছে। টাকার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করছে না। কিন্তু রেল সঠিকভাবে পরিকল্পনা নিতে পারছে না। যে কারণে আজ এই পরিস্থিতি।’
২০১১ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের পর ২০১২ সাল থেকে সরকারের উন্নয়ন বাজেটে যুক্ত হয় তারা। নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। রেলপথকে ঢেলে সাজাতে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণের পাশাপাশি সিঙ্গেল লাইনকে ডাবল, সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, নতুন নতুন স্টেশন, নতুন ইঞ্জিন ক্রয়, কোচ ক্রয়ের জন্য নেওয়া হয় আলাদা আলাদা প্রকল্প। রেলওয়ে বলছে, গত ১২ বছরে প্রায় অর্ধশত প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। যার সিংহভাগই চলমান। তবে তা চলছে কচ্ছপ গতিতে। বর্তমানে রেলওয়ের হাতে প্রকল্প আছে ২৮টির মতো। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগের-ই মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি বেড়েছে ব্যয়ও।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ‘সবার আগে দরকার ছিল, যে লাইনগুলো রয়েছে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা, লাইনের নিচে পাথর দেওয়া, উপযুক্ত বগি ও কোচ কেনা। যে ইঞ্জিন দিয়ে রেল চলে তার প্রায় ৭০ শতাংশেরই মেয়াদ নেই। একই অবস্থা কোচের ক্ষেত্রে। এই জায়গাগুলোতে রিপ্লেস দরকার ছিল। এসব কাজ যাত্রী সেবার অন্যতম উদ্যোগ। এসব উদ্যোগ না নিয়ে মনযোগ দেওয়া হয়েছে লাইন সম্প্রসারণে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দরকার ছিল আয় আগে, পরে ব্যয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্ষেত্রে ব্যয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আগে, পরে আয়ের কথা চিন্তা করা হয়েছে। আর এই আয়ের কথা চিন্তা করে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। ফলে যাত্রীরা হচ্ছেন রেল বিমুখ।’
ট্রেন একটা আর্টিকুলেটেড জোড়া লাগানো গাড়ি। এটিতে হঠাৎ ব্রেক করা যায় না। কারণ, এতে যাত্রীরা ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এ কারণেই ট্রেনের নীতিমালায় বলা আছে যে, রেল ট্র্যাকের ১০ ফুটের মধ্যে সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে অলিখিতভাবে। কেউ তার আশেপাশে আসতে পারবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র এর উল্টো। রেলের জমিতে হাট-বাজার, বসতি বানিয়ে রেললাইনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২৪ অক্টোবর কমলাপুর স্টেশনের কাছে পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের বগি লাইনচ্যুতের ঘটনা তুলে ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন আসুক, তার পর দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।’ এ সময় তিনি রেলের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন। যা বাস্তবায়ন হলে এসব সমস্যা শূন্যে নেমে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বড় গণপরিবহন রেলওয়ে। যাতায়াতে সবচেয়ে নিরাপদ যানবাহন হিসেবে রেলকেই বেছে নেয় মানুষ। কিন্তু, সারা বিশ্বে রেলকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে সবসময় রেল থেকেছে অবহেলিত।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম