এশিয়াটিক অয়েলে ফের অস্থিরতা, বন্ধ আতঙ্কে কর্মীরা
২৭ অক্টোবর ২০২৪ ২২:১৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশের জ্বালানি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে (এসএওসিএল) অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের আতঙ্কে ভুগছেন।
তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরিভাবে বেসরকারি খাতে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চক্রান্ত হয়েছিল। তখন আন্দোলন করে শ্রমিক-কর্মচারীরা সেটা ঠেকিয়েছিলেন। বর্তমানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও একই চক্র নানা কৌশলে এসএওসিএলকে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে একটি বড় শিল্পগ্রুপের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে।
আর এতে নেপথ্য থেকে মদদ দিচ্ছেন বিপিসি কর্মকর্তা মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ, যিনি এসএওসিএল-এ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের (সদ্য নিষিদ্ধ) সাবেক নেতা মোরশেদ বর্তমানে বিপিসি’র উপ-মহাব্যবস্থাপক (বণ্টন ও বিপণন) পদে আছেন।
১৯৬৫ সালে দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে (এসএওসিএল) প্রতিষ্ঠা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ৫০ শতাংশ শেয়ার কিনে এসএওসিএল’র নিয়ন্ত্রণ নেয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৫০ শতাংশের মালিক বাংলাদেশ সরকার বা বিপিসি এবং বাকি ৫০ শতাংশের মালিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্যা এশিয়াটিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ঢাকা। তবে পরিচালনার শর্তানুযায়ী এসএওসিএল বিপিসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়।
এসএওসিএল বিপিসি’র মাধ্যমে লুব্রিকেটিং অয়েল আমদানি ও বিপণন করে। এছাড়া লুবজোন ব্র্যান্ডের ইঞ্জিন অয়েল, গিয়ার অয়েল, সিএনজি ইঞ্জিন অয়েল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অয়েল, মেশিন অয়েল ও আন্তর্জাতিক মানের গ্রিজ বিক্রি করে। ২২ হাজার মেট্রিকটন ধারণক্ষমতার একটি অয়েল স্টোরেজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব আছে। এর বার্ষিক উৎপাদন বা বিপণন সক্ষমতা হচ্ছে ২৫ হাজার মেট্রিকটন লুব্রিকেন্ট। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।
জানা গেছে, ক্রমাগতভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এসএওসিএল লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। এ অবস্থায় ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অডিট অধিদফতর ২০১২-২০১৩ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের আয়-ব্যয়, ফান্ড ও বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে সম্পাদিত কাজের রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৪৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৫৪৭ টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। ২০২১ সালের ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই বছর ১০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ছাঁটাই করা হয়।
এ অবস্থায় রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া এসএওসিএলকে ফের সচল করতে ২০২১ সালে বিপিসি’র মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণিলাল দাশকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) করে পাঠানো হয়। তিনি এখনও দায়িত্ব পালন করছেন।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২১ সালে এসএওসিএল’র পুঁজি ছিল মাত্র নয় কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে সেই পুঁজি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আগে প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র খোলাবাজারে লুব্রিকেটিং অয়েল সরবরাহ করতো। গত চার বছরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী এবং কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্য সরবরাহ করছে। ফলে দায়-দেনা পরিশোধ নিয়মিত হয়ে ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এসএওসিএল। এ কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও এখন নিয়মিত পরিশোধ করা হচ্ছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসএওসিএল’র অভ্যন্তরে ফের অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে নামে-বেনামে অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ কর্মচারীদের উসকানি দিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর নগরীর পতেঙ্গার গুপ্তখাল এলাকায় এসএওসিএল কার্যালয়ের অদূরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রতিষ্ঠানের পাঁচ কর্মচারীকে আসামি করে মামলা হয়েছে।
এসএওসিএল’র জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (হিসাব) ও অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এ প্রতিষ্ঠান একসময় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। তখন সেটাকে বিপিসি বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের ভেতরের কিছু লোকজনকে নেপথ্য থেকে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে, যাতে প্রতিষ্ঠানের ভেতর অস্থিরতা তৈরি করে সেটাকে ফের রুগ্ন করে ফেলা যায়। সেজন্য অফিসারের ওপর হামলা, অপপ্রচারসহ নানা ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে।’
‘এটাকে আগেও একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী তাদের মালিকানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। আমরা সেটা আঁচ করতে পেরে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিরোধ করেছিলাম। এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবারও সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। এতে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আবারও উদ্বেগ, আতঙ্ক তৈরি হয়েছে,’ – বলেন মোহাম্মদ আলমগীর।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (উৎপাদন) কামরুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসএওসিএল একটা লুব্রিকেটিং অয়েল ব্র্যান্ডিং কোম্পানি। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের ক্লায়েন্ট। আমরা এখন খোলাবাজারে তেমন সেল করি না। এজন্য কিছু মধ্যস্বত্ত্বভোগী ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে পারছে না, তারা হয়তো ক্ষুব্ধ। এজন্য সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে। ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। যে অডিট আপত্তির কথা বলে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেটা তো বর্তমান ব্যবস্থাপনার আগের আমলের ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানের অডিট নিয়ে আপত্তি থাকতেই পারে। এটা তো অনিয়ম না, নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে বলা যায়। এখন যদি অস্থিরতা তৈরি হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রভাব পড়বে। এতে ফের স্থবির ও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আমাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে ২৫ হাজার মেট্রিকটন লুব্রিকেন্ট। আমরা ১২ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিকটন প্রসেস করি। এটা বন্ধ হয়ে গেলে বাজারেও তো প্রভাব পড়বে।’
এসএওসিএল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি কায়সার হামিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিপিসির কর্মকর্তা মোরশেদ হোসাইন আজাদ এখানে একসময় কর্মরত ছিলেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র করেন। কোম্পানির নয়টি গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। স্ক্র্যাপসহ কোম্পানির বিভিন্ন সম্পদ তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কম দামে বিটুমিন বিক্রি করে দিতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটা পুরোপুরি বন্ধ করে ফেলা।’
তিনি বলেন, ‘মোরশেদ হোসাইন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। নিজের অনুসারীদের নিয়ে শ্রমিক লীগের নামে একটা কমিটি করতে চেয়েছিলেন। তিনি এবং তার লোকজন মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি বড় শিল্পগ্রুপের কাছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। আমরা আন্দোলন করে উনাকে এখান থেকে বের করে দিই। আন্দোলন করায় তিনি আমাকে টার্মিনেট করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দোসর। এখন আবার নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসি’র উপ-মহাব্যবস্থাপক (বণ্টন ও বিপণন) মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এসএওসিএল-এ ছিলাম। আমার দায়িত্বকালীন প্রতিষ্ঠানটিকে বেসরকারি খাতে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমি যা করেছি, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে করেছি। পর্ষদের কোনো সভায় এমন কোনো এজেন্ডা ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন প্রতিষ্ঠানটিতে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেগুলোও আমি জানি না। আমি সেখান থেকে চলে আসার পর প্রতিষ্ঠানটির কাউকে কোনোদিন একটা ফোনও করিনি। এখন তো টেকনোলজি খুব হাই। যে কেউ তদন্ত করলে এটার প্রমাণ পাবেন।’
এমতাবস্থায় রোববার (২৭ অক্টোবর) নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন এসএওসিএল’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মণিলাল দাশ। প্রতিষ্ঠানটির গত তিন বছরের কার্যক্রম তুলে ধরে সিইও তিনি বলেন, ‘আমি ২০২১ সালে যখন দায়িত্ব নিই, তখন কোম্পানির পুঁজি ছিল মাত্র নয় কোটি টাকা। এখন পুঁজি প্রায় ২০০ কোটি টাকা। বিপিসির কাছে তেল কেনা বাবদ বকেয়ার পরিমাণ ছিল ১১৯ কোটি টাকা। আমরা প্রতিমাসে লভ্যাংশ থেকে ৫০ লাখ, এক কোটি টাকা করে পরিশোধ করে সেটা ৬০-৬২ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছি। একটা কোম্পানির যদি নিয়মিত এজিএম না হয়, তাহলে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে তো সেটা আর কোম্পানিই থাকে না। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে কোম্পানি কোনো বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হয়নি। আমি আসার পর উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়ে চারটা এজিএম করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এখানে কোনো অডিট হয়নি। সেজন্য কিছু অডিট আপত্তি তৈরি হয়। সেটা সরকার সংকলনভুক্ত করে ফেলে। যার পরিমাণ ৪৭২ কোটি টাকার মতো। তখন কিছু কর্মী ছাটাই করা হয়। এর পর বেচা-বিক্রিসহ এ কোম্পানির সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আমি এসে বিপিসিকে বন্ড দিয়ে চালু করি। বিভিন্ন জায়গায় মার্কেটিং করেছি। ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, বন্দর, রিফাইনারি, কাফকো, বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র – এ ধরনের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লায়েন্ট আমি সংযোজন করতে সক্ষম হই।’
এসএওসিএল’র প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আমাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। কোম্পানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা উঠে এসেছি। এখন লাভের মুখ দেখছে কোম্পানি। বেতন-ভাতা নিয়মিত হয়েছে।’
মণিলালের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠান যখন স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন কিছু কুচক্রিমহল বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে অপপ্রচার করছে।
‘৪৭২ কোটি টাকার অডিট অবজেকশন, সেটা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। এটা তো আমার মেয়াদের বিষয় নয়। আর অডিট অবজেকশন তো থাকতেই পারে, সেটা সংশোধনও করা সম্ভব। এর পরও নানা প্রোপাগাণ্ডা এ কোম্পানিকে নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে। এটা কী আমাকে সরানোর জন্য হচ্ছে, না কি পুরোপুরি প্রাইভেট খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য করছে, বুঝতে পারছি না’– বলেন মণিলাল দাশ।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম