Monday 28 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেরোবির ৩ শিক্ষকের নিয়োগ জালিয়াতি অনুসন্ধানে কমিটি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ০২:০০

ফাইল ছবি: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

রংপুর: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের নিয়োগ জালিয়াতি খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সোমবার (২৮ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যলয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের ১০৮তম এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

নিয়োগে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত তিন শিক্ষক হলেন– বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ ও গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আইরিন আক্তার।

উপাচার্য বলেন, ‘সম্প্রতি এই তিন শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতেই তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট। তথ্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।’

সম্প্রতি ড. তুহিন ওয়াদুদ, মোহাম্মদ ইউসুফ এবং আইরিন আক্তারকে নিয়ে গণমাধ্যমে তাদের নিয়োগ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। এর পর তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবি উঠে বিভিন্ন মহলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিন জন শিক্ষকের নিয়োগ জালিয়াতি খতিয়ে দেখতে তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ড. তুহিন ওয়াদুদের নিয়োগ নিয়ে যা অভিযোগ

প্রকাশিত সংবাদে অভিযোগ করা হয়, ২০০৯ সালের মার্চ মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত ভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে ড. তুহিন ওয়াদুদকে নিয়োগ দেয় তৎকালীন উপাচার্য ড. অধ্যাপক লুৎফর রহমান। ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ওই বছরের নভেম্বর মাসে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী প্রভাষক পদে আবেদনের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল শিক্ষাজীবনে সর্বস্তরে প্রথম বিভাগ/শ্রেণি অথবা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ থাকতে হবে। তবে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা থাকলেও একাডেমিক ফলাফলের শর্ত শিথিলের বিষয়ে কিছু বলা ছিল না। অথচ ড. আবু ছালেহ মোহাম্মদ ওয়াদুদুর রহমান (তুহিন ওয়াদুদ) তার শিক্ষা জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই প্রথম শ্রেণি পাননি। তার আবেদনপত্রে দেখা যায়, তিনি ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাদরাসা বোর্ড থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। এর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

বিজ্ঞাপন

আরও অভিযোগ উঠে, ২০২১ সালে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান তুহিন ওয়াদুদ। ২০২১ সালে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদ শূন্য হয়। ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার জন্যই সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. হাসিবুর রশীদ তড়িঘড়ি করে ওই নিয়োগ সম্পন্ন করেন। অধ্যাপক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদের সংখ্যা ছিল দুটি, কিন্তু আবেদনকারী প্রার্থী ছিলেন একজন। তারপরও একমাত্র প্রার্থী ড. তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়য় বাংলা বিভাগের অধ্যাপকের শূন্যপদে নিয়োগ নিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নিয়োগ-বোর্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা নয়।

মোহাম্মদ ইউসুফের নিয়োগ নিয়ে যা অভিযোগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ– আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও নজীরবিহীন অনিয়ম করে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান মো. ইউসুফ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে আওয়ামীপন্থী সব পেশাজীবী সংগঠনের ছায়ায় আশ্রয় নেন।

জানা যায়, এসএসসিতে অংকে সি ও এইচএসসিতে ইংরেজিতে ডি পেয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন মো. ইউসুফ। এই শিক্ষক এসএসসিতে জিপিএ ৩.৫০, এইচএসসিতে ৩.১ পেয়েছেন।

অথচ নিয়োগের বিষয়ে পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল, অবশ্যই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যেকোনো একটিতে জিপিএ-৪ (এ) পেতে হবে এবং স্নাতকে প্রথম শ্রেণি (ন্যূনতম ৩.৫) থাকতে হবে। অথচ আবেদন করার শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরও নিয়োগ কমিটি কোন ক্ষমতায় তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, আর তিনি ছয় বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে শিক্ষকতা করছেন- এমন প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে একজনকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, প্ল্যানিং কমিটি গঠন না করেই শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির শর্তাবলীর আলোকে আবেদনকারীদের যোগ্যতা যেন যাচাই-বাছাই না করা হয়- সে জন্যই প্ল্যানিং কমিটি গঠন কর হয়নি। এই বিভাগে শুধুমাত্র একটি পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও বাছাই বোর্ড তিন প্রার্থীকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের সুপারিশ করে- যা বেআইনি। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী ইউসুফের যোগ্যতা পূরণ না হলেও তাকে অন্যায়ভাবে ভাইভা কার্ড ইস্যু করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও ইউসুফকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেন।

অভিযোগে আরও স্পষ্ট হয়, ইতিহাস বিভাগে একটি স্থায়ী পদের কথা উল্লেখ থাকলেও তিন জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। আর নিয়োগদানের সুপারিশের সব লেখা টাইপ করা থাকলেও প্রভাষক পদে ‘এক’ শব্দটি কলম দিয়ে কেটে ‘তিন’ লিখে দেওয়া হয়- যা অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

নিয়োগ জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হলে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় সদস্যরা সর্ব সম্মতিক্রমে মো. ইউসুউফকে বাদ দিয়ে অন্য দুজনকে যোগদানের অনুমতি দেন। যোগদান করতে না পেরে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে তিনি রিট করেন। রিট পিটিশনে মো. ইউসুফ তার নিয়োগ সিন্ডিকেট কেন বাতিল করল সেটি উল্লেখ করেননি। অভিযোগ ওঠে তিনি তথ্য গোপন করে গত ২০১৯ সালের ৯ জুলাই হাইকোর্ট মো. ইউসুফের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু তৎকালীন ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ওই রায়ের বিপক্ষে আপিল না করায় মো. ইউসুফ ওই বিভাগে ১৪ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রভাষক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এর পর বাগিয়ে নিয়েছেন প্রমোশন, হয়েছেন সহকারী অধ্যাপক।

আইরিন আক্তারের নিয়োগ নিয়ে যা অভিযোগ

মো. ইউসুফের মতোই একই অভিযোগ গণিত বিভাগের শিক্ষক আইরিন আক্তারের। শিক্ষক পদে আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে প্রথমে প্রভাষক পরে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ উঠে।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক পদে শিক্ষক না থাকায় ওই পদের বিপরীতে ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর আইরিন আকতারকে প্রভাষক (অস্থায়ী) নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে কৌশলে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসের শিক্ষাছুটিতে পাঠিয়ে অধ্যাপক পদের বিপরীতে থাকা প্রভাষক পদটি খালি দেখানো হয়। এরপর আইরিন আক্তারকে যে পদে স্থায়ী করার কথা, সেই অধ্যাপক পদে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

আরও জানা যায়, ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর গণিত বিভাগে অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপকের (স্থায়ী) দু’টি পদের জন্য যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়, তাতে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যেকোনো একটিতে ন্যূনতম ‘এ’ (৫.০০ পয়েন্টভিত্তিক গ্রেড সিস্টেমে জিপিএ ন্যূনতম ৪.০০ চতুর্থ বিষয় বাদে এবং চতুর্থ বিষয়সহ ৪.৫০) থাকতে হবে। তবে আইরিন আক্তারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.০০ পাননি। রাজশাহী বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ ৩.৭৫।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সহকারী অধ্যাপক (স্থায়ী) পদের ঠিক নিচে ব্র্যাকেটে ‘কনসিকোয়েন্সি ভেকান্সি উইথ ফিলাপ’র মাধ্যমে ‘শূন্য পদ’ লেখা হয়েছে। আবেদনের শর্তে প্রতিটি স্তরে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ প্রার্থীর ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা যেতে পারে। তবে একজন প্রার্থীর ক্ষেত্রে কী কী বিষয়ে শর্ত শিথিল হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় আইনের কোথাও রেজাল্ট শিথিলের কথা উল্লেখ নেই।

তবে অভিযোগ আছে, বিজ্ঞপ্তিতে অভ্যন্তরীণ প্রার্থীর ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের কথা জুড়ে দিয়ে আইরিন আক্তারকে অস্থায়ী প্রভাষক থেকে এক লাফে সহকারী অধ্যাপক পদে নেওয়া হয়।

সারাবাংলা/পিটিএম

জালিয়াতি টপ নিউজ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর