Tuesday 29 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কর্ণফুলী টানেলে ১ বছরে লোকসান শত কোটি টাকা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ২২:০৯

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত সুড়ঙ্গপথ (টানেল) দিয়ে গাড়ি চলাচলের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল ও আয় এবং পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। এর ওপর আছে টানেল প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধের বাস্তবতা। সব মিলিয়ে দেশে নির্মিত প্রথম এ টানেলের চিত্র পুরোপুরি হতাশাজনক।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল, টোল হিসেবে আদায় করা টাকা এবং পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয়ের হিসাবে এ মেগাপ্রকল্পে গত এক বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। গত এক বছরে টানেলের আয় ৩৮ কোটি ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫০ টাকা। আর টানেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সেই হিসাবে লোকসানের পরিমাণ ৯৮ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ৪৫০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেল উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন সেটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

টানেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, উন্মুক্ত করার পর এক বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৪৪টি। দিনে গড়ে গাড়ি চলাচল করেছে ৩ হাজার ৯২৫টি। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ লং ভেহিক্যাল (ভারি যান), ১০ শতাংশ বাস, ১৩ শতাংশ ট্রাক ও এক শতাংশ ট্রেইলর।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চলার কথা। ২০২৫ সাল থেকে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি, ২০৩০ সাল থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৬২ হাজার গাড়ি চলাচলের কথা সমীক্ষায় বলা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের প্রবেশ পথ। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের প্রবেশ পথ। ছবি: সারাবাংলা

কিন্তু উন্মুক্ত হওয়ার প্রথম বছরে দিনে গাড়ি চলেছে ৩ হাজার ৯২৫টি করে, যা সমীক্ষার চেয়ে ১৪ হাজার ৫৬০টি কম। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরেও টানেল দিয়ে আশানুরূপ গাড়ি চলাচল করবে না ও আয়-ব্যয়ের ব্যবধান হতাশাজনকই থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

টানেলের উপপ্রকল্প পরিচালক ও সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গাড়ি চলাচলের যে হিসাব নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে গত এক বছরে গাড়ির সংখ্যায় অনেক ব্যবধান হয়েছে। সম্ভাব্যতা প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল আনোয়ারা প্রান্তে শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বন্দরের সম্প্রসারণকে ভিত্তি করে। কিন্তু বাস্তবে এগুলো হয়নি। গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে একটা সংযোগের কথা বলা হয়েছিল, সেটাও হয়নি। তাহলে প্রত্যাশিত গাড়ি টানেলে ঢুকবে না, সেটাই স্বাভাবিক।’

টানেল কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত টোল থেকে টানেল কর্তৃপক্ষ আয় করেছে ৩৮ কোটি ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫০ টাকা। দিনে গড়ে আয় হয়েছে ১০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

আর এক বছরে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। দিনে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী টানেলের আয়-ব্যয়ের ব্যবধান অর্থাৎ লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বছরে ৯৮ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ৪৫০ টাকা।

টানেলের মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এটি দেশের নদী তলদেশের প্রথম টানেল। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেলটির উদ্বোধন করা হয়। চীনা ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এ টানেল তৈরি করা হয়েছে। টানেল তৈরিতে ব্যয় হয় ১০ হাজার ২৫৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে চীনের ঋণ ৬ হাজার ৭৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের প্রবেশ পথ। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের প্রবেশ পথ। ছবি: সারাবাংলা

গাড়ি চলাচলের আয় দিয়ে টানেলের নিয়মিত পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের যেখানে সংকুলান হচ্ছে না, সেখানে ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে বেগ পেতে হবে সরকারকে- এমন মত সংশ্লিষ্টদের।

বিপুল ব্যয়ে টানেল নিমার্ণের মেগাপ্রকল্প নেওয়ার পরই এর যৌক্তিকতা নিয়ে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল। আশঙ্কা করা হয়েছিল, উন্নয়নের পরিবর্তে টানেলটি শেষপর্যন্ত মাথাভারী প্রকল্প হিসেবে সরকারের মাথাব্যাথার কারণ হবে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের মতে, শুধুমাত্র টোলের টাকা দিয়ে টানেলের নিয়মিত পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মেটানো সম্ভব হবে না। মীরসরাই শিল্পনগরী থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া-মাতারবাড়ি হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত এ টানেলের প্রত্যাশিত ব্যবহার হবে না। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও মীরসরাই শিল্পাঞ্চল চালু হলে টানেলের ব্যবহার বাড়বে এবং প্রত্যাশিত আয় আসবে।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সাংবাদিক মুস্তফা নঈম সারাবাংলাকে বলেন, ‘টানেল প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, তখনই আমরা সেটার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আদৌ এর ব্যবহার কতটুকু হবে, সেটা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। টানেলের ব্যবহার প্রত্যাশিত পরিমাণে হচ্ছে না। তার চেয়ে যদি কালুরঘাট সেতুটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ করা হতো, তাহলে চট্টগ্রামের মানুষ আরও বেশি সুফল পেত। অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হতো এ সেতু।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

কর্ণফুলী টানেল লোকসান শত কোটি টাকা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর