৮ বছর ‘আয়না ঘরে’: গুম কমিশনে অভিযোগ ব্যারিস্টার আরমানের
২৯ অক্টোবর ২০২৪ ২২:২৮ | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ ২২:২৯
ঢাকা: গুম হওয়ার দীর্ঘ ৮ বছর পর কথিত বন্দিশালা ‘আয়না ঘর’ থেকে মুক্ত হওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশেম (আরমান) গুম কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত গুম কমিশনে ব্যারিস্টার আরমানের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন অভিযোগ দাখিল করেন। এরপর গুম কমিশনে সদস্য নূর খান লিটন আবেদন গ্রহণ করে গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন।
অভিযোগে ব্যারিস্টার আরমান বলেছেন, ‘২০১৬ সালের ৯ আগস্ট রাত ১১টার দিকে আমার বাসা সিভিল পোশাক পরিহিত ৭ থেকে ৮ জন ব্যক্তি বাসার কলিং বেল প্রেস করে। দরজা খুলে দিলে তারা বাসায় প্রবেশ করে। তাদের সবার কাছে অস্ত্র ছিল এবং অস্ত্রের মধ্যে সিরিয়াল নম্বরও লেখা ছিল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা কোনো বাহিনীর লোক। তখন তারা আমাকে বলে যে, আমার কাছে তাদের কিছু প্রশ্ন আছে এবং আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। আমি বলেছিলাম আপনারা কারা, কেন আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার নামে কোন ওয়ারেন্ট আছে কিনা? তারা বলে, আমাদের সঙ্গে গেলেই সব বুঝতে পারবেন। পরে জোরপূর্বক আমাকে আমার স্ত্রী-সন্তানদের সামনে থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। সাদা মাইক্রো গাড়িতে উঠিয়ে তারা আমার হাত ও চোখ বেঁধে দেয়। আমি বলি আমার চোখ বাঁধছেন কেন? তারা বলেন, এটাই আমাদের নিয়ম এবং সঙ্গে গেলেই সবকিছু বুঝতে পারবেন।’
অভিযোগে ব্যারিস্টার আরমান আরও বলেন, ‘আমার পিতা মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে কথিত বিচার শুরু করেন। আমি আমার বাবার মামলা পরিচালনায় পারিবারিকভাবে দায়িত্বরত ছিলাম এবং একজন আইনজীবী হিসেবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনজীবী প্যানেলের সাথে বাবার হয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সে কারণে বাবার মামলা সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল। বাবার মামলাটি যখন শেষ পর্যায়ে ছিল অর্থাৎ ট্রাইবুনালের রায়, এরপর আপিল, আপিলের পর রিভিউ শুনানির একেবারে শেষ পর্যায়ে এবং কিছুদিন পরেই রায় কার্যকর হয়ে যাবে। এমতাবস্থায়, বাবার মামলা পরিচালনা এবং ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্থ করার পূর্বপরিকল্পিত উদ্দেশ্যেই আমার বাবা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার চার সপ্তাহ পূর্বে আমাকে জোরপূর্বক গুম করা হয়। পরিবারের সদস্যরা আমার নিখোঁজ হওয়ার সাথে সাথেই নিকটস্থ পল্লবী থানায় শরণাপন্ন হলে দায়িত্বরত অফিসাররা কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি এবং আমাকে খুঁজেতে কোন সহযোগিতা করেনি। বরং আমি আত্মগোপন করেছি বলে আমার পরিবারের সদস্যদের কাছে অপবাদ দেওয়া হয়।
অভিযোগপত্র থেকে আরও জানা যায়, অতঃপর তারা আমাকে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটি নির্জন কক্ষে/সেলে বন্দি করে রাখে। জায়গাটি কোথায় আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি যে, সেলটি খুবই পুরোনো ছিল। সেখানে আমি ১৬ দিন অবস্থান করি। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া এবং মেঝেতে ইঁদুর ঘুরে বেড়াতো। সার্বক্ষণিক তারা আমার চোখ ও হাত বেঁধে রাখতো। সেখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমি প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। ১৬ দিনের মাথায় এক মধ্যেরাতে আমাকে সেখান থেকে গাড়িতে করে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। বুঝতে পারছিলাম না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আনুমানিক আধা ঘণ্টার মধ্যে আমাকে নিয়ে তারা অন্য একটা জায়গায় পৌঁছায়। সেখানে টাইলস করা মেঝে আর রুমের সাথে টয়লেট ছিল। সেখানকার প্রহরীরা অনেক কঠোর ছিল। তাদের কথাবার্তা খুবই কঠোর, চাল-চলন অনেক সুশৃঙ্খল, খাওয়া দাওয়ার বিষয়টিও ছিল নিয়মতান্ত্রিক। সব সময় বলত তাদের উপর আদেশ করা হয়েছে। দিনের বেলা দুই হাতে সামনের দিক থেকে হাতকড়া পরানো থাকতো আর রাতে হাত পিছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে রাখতো। টয়লেটের ভেতর গোসল করার সময় হাত খোলার অনুমতি ছিল। এক হাতে হাতকড়া পরানো থাকতো, আরেক হাত খোলা থাকতো। গোসল শেষ করে ভালোমতো চোখ বেঁধে ওদেরকে আওয়াজ দিতে হতো। তখন ওরা এসে আবার চেক করতো সব ঠিকঠাক বাঁধা আছে কিনা। তারপর তারা চলে যেতো।
তবে তিন বেলা খাবার দেওয়া হতো। গোসলের সময় বাম হাত খুলে দিতো আর খাবারের সময় ডান হাত খুলে দিতো। যখন হাতকড়া খুলে দিতো তখন একটু চোখ খুলতে পারতাম কিন্তু ওরা বকাবকি করতো। কোনদিকে তাকানোর নিয়ম ছিল না। প্রচন্ড কঠোরতা অবলম্বন করা হতো।
আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে খুব কাছেই ইন্টারোগেশন রুম ছিল। আমি ইন্টারোগেশনের হালকা আওয়াজ শুনতে পেতাম। যাদের উপর নির্যাতন চলছে তাদের আওয়াজে ঘুমাতে পারতাম না। এভাবে দীর্ঘ আট বছর আমাকে সেখানে গুম করে রাখা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কোনো প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ছোঁয়া পাইনি। হাতকড়া অবস্থায় নামাজ পড়তে হতো। একহাত দিয়ে রুকু করতে হতো, এক হাত দিয়ে সেজদা করতে হতো। একবার ডান হাত একবার বাম হাতে। প্রথম বন্দিশালা থেকে দ্বিতীয় বন্দিশালা/টর্চার সেলে অনেক বেশি সিসটেমেটিক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হতো। সেখানে মাঝেমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসতেন। তারা যখন আসতো তখন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে হতো, নড়াচড়া করতে দেওয়া হতো না। সারাদিন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে হতো। আমাকে এক অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। জীবিত ব্যক্তিদের জন্য এই বন্দিশালা ছিল একটি কবরের মতো। সুপরিকল্পিতভাবে এবং সিসটেমেটিক পদ্ধতি অবলম্বন করে এমনভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো যাতে বন্দিরা যেন মৃত্যুর চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। তাদের নিয়ম-কানুন ও কঠোরতা দেখে মনে হয়েছে তারা সেনাবাহিনীর সদস্য বা কর্মকর্তা। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মুহূর্তের জন্য আমাদের মুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না বা স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। সরকারের অবগতি, নির্দেশ বা সহযোগিতা ব্যতীত কারও পক্ষে এত মানুষকে দিনের পরে দিন বা বছরের পর বছর গুম করে রাখার সুযোগ নাই।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, অপহরণের বিষয়ে প্রথমে পুলিশ কোন অভিযোগ বা মামলা না নিলেও পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট আমার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (ডায়েরী নং-৮০৮)। অতঃপর তাহমিনা আক্তার গত ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর পল্লবী থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। তেজগাঁও জোনাল টিম, ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবুল বাশার কর্তৃক ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। তদন্তে আমার অপহরণের সত্যতা পাওয়া গেলেও কাউকে অভিযুক্ত করে কোন চার্জশিট প্রদান করা হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে সত্য গোপন করে দায়ী ব্যক্তিদের বাচানোর জন্য উক্ত মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করা হয়।
অতঃপর উক্ত ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে বাদী তহমিনা আক্তার নারাজী দরখাস্ত দাখিল করেন। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এমতাবস্থায় উক্ত বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মর্জি হয়।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এইচআই