এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ দশকের পর থেকে পৃথিবীতে খরাপ্রবণ এলাকা তিনগুণ বেড়েছে।
ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরার প্রভাব দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। গত বছর পৃথিবীর ৪৮ শতাংশ ভূমি অন্তত এক মাসের জন্য চরম খরার কবলে পড়েছিল, যা ১৯৮০-এর দশকে গড়ে মাত্র ১৫ শতাংশ ছিল।
চরম খরার প্রকোপ ক্রমাগত বাড়ছে
২০২৩ সালে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা তিন মাস বা তারও বেশি সময় চরম খরার মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে ১৯৮০-এর দশকে গড়ে এ হার ছিল মাত্র পাঁচ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, এই দ্রুত বৃদ্ধি উদ্বেগজনক যা খরার প্রভাব আরও তীব্র হচ্ছে।
চরম খরার সংজ্ঞা থেকে জানা যায়, ছয় মাসের কম বৃষ্টিপাত বা অত্যধিক বাষ্পীভবনের কারণে খরার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। খরা পানীয় জল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ এবং পরিবহন যোগাযোগের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এবং অর্থনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাববিশিষ্ট অঞ্চল
বিশ্বব্যাপী খরার প্রকোপ বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনে খরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা স্থানীয় আবহাওয়ার ওপর প্রভাব ফেলছে। সেখানে গাছ মারা যাচ্ছে, যা বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি করতে সহায়ক ছিল; এতে করে ভারসাম্যপূর্ণ বৃষ্টিপাতের চক্র বিঘ্নিত হচ্ছে এবং আরও খরার দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে।
খরা ও অতিবৃষ্টির দ্বৈত চ্যালেঞ্জ
যদিও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চল খরার সম্মুখীন হলেও কিছু অঞ্চলে একই সময়ে অতিবৃষ্টির পরিমাণও বেড়েছে। গত দশকে ৬১ শতাংশ এলাকা অতিবৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছে, যা ১৯৬১-১৯৯০ সালের গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। খরা এবং অতিবৃষ্টির এই বৈপরীত্য পরিস্থিতি সৃষ্টিতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান ভূমিকা রাখছে।
অতিবৃষ্টি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় দেখা গেছে, উষ্ণ আবহাওয়ায় মাটির পানির বাষ্পীভবনের হার বাড়ে, যা বৃষ্টির অনুপস্থিতিতে ভূমিকে আরও শুষ্ক করে তোলে। অন্যদিকে, যখন সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন বাতাসে বেশি পরিমাণে জলীয় বাষ্প জমা হয়, যা পরবর্তীতে স্থলভাগে অতিবৃষ্টিপাতের সৃষ্টি করে।
খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব
ল্যানসেট কাউন্টডাউন প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যগত প্রভাব রেকর্ড পরিমাণে পৌঁছেছে। খরার কারণে গত বছর ১৫১ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হয়েছে, যা অপুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাপজনিত কারণে মৃত্যু হার ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ১৬৭ শতাংশ বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্যে প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন মশাজাতীয় রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই রোগগুলি এখন এমন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে আগে এগুলো পাওয়া যেত না। এছাড়া, ধূলিকণার কারণে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েছে, যা বিশ্বের কয়েক মিলিয়ন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খরাপ্রবণ অঞ্চলে পানির সংকট
ল্যানসেট কাউন্টডাউনের নির্বাহী পরিচালক মারিনা রোমানেলো বলেন, ‘জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এটি এমন একটি পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, যা আমরা সামলাতে প্রস্তুত নই।’ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া এবং ইরাকের কিছু অংশ ২০২০ সাল থেকে চরম খরার শিকার। হাশাকা শহরে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ এখন বিশুদ্ধ পানি সংকটে ভুগছে। এই সংকটে পানি প্রাপ্তির জন্য মানুষ নলকূপ তৈরি করছে, তবে এসব ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণ থাকায় রোগ ছড়াচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে ভবিষ্যতের আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাওয়া রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও দীর্ঘমেয়াদী খরা এবং অতিবৃষ্টির মুখোমুখি হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা মানিয়ে নেওয়া গেলেও, ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানুষের সহনশীলতার সীমাকে অতিক্রম করে ফেলবে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকরা।