‘বিতর্কিত’ ফজলুল্লাহর ১৫ বছর: বড় প্রকল্প, বড় কমিশন
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ২০:২৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো মেয়াদে প্রায় ১৫ বছর চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রথমে চেয়ারম্যান ও পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। তার আমলে চট্টগ্রাম নগরীতে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নেওয়া হয় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি প্রকল্প। এর মধ্যে আটটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নগরবাসীর পানির সংকট আর শেষ হয়নি।
বড় বড় প্রকল্প নিয়ে কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, বহু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত তদন্তে নেমেছে। কিন্তু ফজলুল্লাহকে চেয়ার থেকে টলানো যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার বারবার তার নিয়োগের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে গেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফজলুল্লাহকে অপসারণের আন্দোলন শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান তদন্তের দায়িত্ব পান। গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি চট্টগ্রামে এসে বিস্তারিত তদন্ত করে ওই মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেন।
একমাস পর বুধবার (৩০ অক্টোবর) চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি পদ থেকে এ কে এম ফজলুল্লাহকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। একই পদে সাময়িকভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগ চট্টগ্রামের পরিচালক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি ফজলুল্লাহকে অপসারণ
চট্টগ্রাম ওয়াসায় অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বরাবর সোচ্চার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ফজলুল্লাহর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি জানিয়েছে।
এ কে এম ফজলুল্লাহর বয়স ৮০ পেরিয়েছে। ১৯৪২ সালে তার জন্ম। চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নেন ২০০০ সালে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান ফজলুল্লাহ। সেই থেকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
ফজলুল্লাহর মেয়াদে গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম ওয়াসা যেসব বড় প্রকল্প নিয়েছে সেগুলো হলো— কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (সিডব্লিউএসআইএসপি) ও ভান্ডালজুরি পানি সরবরাহ প্রকল্প এবং পয়ঃনিষ্কাশন সংক্রান্ত আরও ছয়টি প্রকল্প। প্রথম চারটি প্রকল্পে ব্যয় ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮০৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বোর্ডে সদস্য ছিলেন— এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্প নিতে বেশি উৎসাহী ছিলেন ফজলুল্লাহ। একাধিকবার মন্ত্রী হয়েছেন চট্টগ্রামের এমন একজন নেতার সঙ্গে ছিল তার বেশ ঘনিষ্ঠতা। মূলত এসব প্রকল্প দুজন মিলেমিশে নিতেন। ওই মন্ত্রীর ভাইকে ঠিকাদারি কাজ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদেরও কাজ কিংবা নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাকে যেভাবে পেরেছেন, ম্যানেজ করতেন তিনি।’
ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়ে কমিশন নিতেন বলে আমরা অনেক অভিযোগ শুনেছি। নিজের মেয়ের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তিনি প্রকল্পের কাজ করেছেন। এখন তিনি আর পদে নেই। দুর্নীতির অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে সবকিছু বের হয়ে আসবে।’
এদিকে পানি সরবরাহের বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ প্রায় শেষ করলেও চট্টগ্রাম নগরীতে সুপেয় পানির সংকট এখনো কাটেনি। অথচ ফজলুল্লাহ একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০২০ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে কোনো পানির সংকট থাকবে না, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পানি পাবেন নগরবাসী। চাহিদা মেটাতে না পারলেও প্রতিবছরই পানির দাম বাড়িয়েছে ওয়াসা।
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। কিন্তু এরপরও গ্রাহকের চাহিদার বিপরীতে ১২ থেকে ১৫ কোটি লিটার পানির ঘাটতি থেকে যায়। ৩০ শতাংশ পানি কারিগরি অপচয়ের নামে নষ্ট হয়।
ওয়াসার এমডি পদে দায়িত্ব পালনের সময় এ কে এম ফজলুল্লাহ নিজের বেতন বাড়ানোর আবেদন, স্বজনদের নিয়োগ, অস্থায়ী কর্মী নিয়োগে টাকা আদায়সহ আরও বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিতর্কিত হয়েছেন।
২০১৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত ৩৫তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ এক লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল বেতন পেতেন। ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি ৬৫তম বোর্ড সভায় তিনি নিজের বেতন ১৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা করার প্রস্তাব তোলেন। দাবি অনুযায়ী বাড়ানো হলে মূল বেতন ও ভাতা মিলিয়ে মাসে তার প্রাপ্য দাঁড়াত ১০ লাখ টাকা। বোর্ড সদস্যদের আপত্তির মুখে অবশ্য সে প্রস্তাব ফিরিয়ে নেন তিনি।
অভিযোগ আছে, চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলামের মাধ্যমে নিয়োগ-পদোন্নতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন ফজলুল্লাহ। অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী করার নামে টাকা আদায় করতেন তাজুল। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ছিল একই ব্যবস্থা। ফজলুল্লাহ ও তাজুল মিলে তাদের কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে ওয়াসায় চাকরি দিয়েছেন।
ক্যাবের এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাজুয়াল কয়েকজন স্টাফকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা বলেছে চাকরি স্থায়ী করার জন্য তারা একজন সিবিএ নেতাকে টাকা দিয়েছেন। এমডি সরাসরি টাকা না নিলেও ওই সিবিএ নেতার মাধ্যমে নিতেন। নিয়োগ-পদোন্নতি, চাকরি স্থায়ীকরণের সব আর্থিক লেনদেন মূলত ওই সিবিএ নেতার মাধ্যমেই হতো। ৫ আগস্টের পর ওই নেতা পালিয়ে গেছেন।’
২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এ কে এম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছিলেন হাসান আলী নামে চট্টগ্রামের এক ব্যক্তি। উচ্চ আদালত এ অভিযোগের বিষয়ে পদক্ষেপ জানতে চেয়েছিলেন। হাইকোর্টের জিজ্ঞাসার পর ওয়াসা ভবনের একটি কক্ষে আগুন লাগে। রহস্যজনক ওই আগুনে কম্পিউটার ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে যায়।
এসব বিষয়ে ওয়াসার এমডি পদ থেকে সদ্য অপসারিত এ কে এম ফজলুল্লাহর বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের কাছে তিনি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। দাবি করেছিলেন, দুদকও তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো প্রমাণ পায়নি।
ক্যাবের বিবৃতি
এ কে এম ফজলুল্লাহকে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি পদ থেকে অপসারণের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, মহানগরী শাখার প্রেসিডেন্ট জেসমিন সুলতানা পারু ও সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান এবং যুব গ্রুপের বিভাগীয় সভাপতি চৌধুরী কে এন এম রিয়াদ ও মহানগরের সভাপতি আবু হানিফ নোমান।
বিবৃতিতে ক্যাব নেতারা বলেন, বিগত সরকারের আমলে আট দফায় ১৬ বছর ধরে অবৈধ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে পদ আঁকড়ে থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য এবং নিজের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। ১৪ বারের বেশি পানির দাম বাড়িয়ে চট্টগ্রামবাসীর ওপর পানির অতিরিক্ত দামের বোঝা চাপিয়েছেন। অথচ এখনো শহরের এক-তৃতীয়ংশ মানুষ ওয়াসার পানি পায় না।
‘তার সব অনিয়ম-দুর্নীতির অবিলম্বে তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা জানতে পেরেছি, তার আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ ওয়াসা কর্মকর্তারা এরই মধ্যে দেশত্যাগ করেছেন। অপসারিত এমডি ফজলুল্লাহ যেকোনো সময় দেশত্যাগ করতে পারেন। তাই অতি দ্রুত তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা না হলে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের মতো পালিয়ে যেতে সক্ষম হবেন,’— বিবৃতিতে বলেন ক্যাব নেতারা।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর