ম্যাংগো ও ক্যাটল স্পেশালের পথেই হাঁটল কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন
২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:২৬
রাজশাহী: গত কয়েক বছরে কোটি টাকা লোকসান হয়েছে ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ও ‘ক্যাটল স্পেশাল’ ট্রেনের। লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়েই আবারও চালু হয়েও বন্ধও হয়ে গেছে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল’ ট্রেন। একদিন চালানোর পরই পশ্চিমাঞ্চল রেল ট্রেনটি বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।
গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) রাজশাহী থেকে ট্রেনটি ছেড়ে গেলেও রহনপুর-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে উঠানো হয়নি কোনো কৃষিপণ্য। রাজশাহী থেকে শুধু উঠেছিল ১৫০ কেজি ডিমের ট্রে (খাঁচা)। অন্য কোনো স্টেশন থেকেও আশানুরূপ পণ্য উঠেনি। প্রথম দিনেই রেলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৭২ টাকা।
‘কৃষিপণ্য স্পেশাল’ ট্রেন বন্ধ ঘোষণা করার নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের (পশ্চিমাঞ্চল) চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার সুজিত কুমার বিশ্বাস। তিনি শনিবার (২ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জানান, ট্রেনটি চালুর পর কৃষক বা কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীদের তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তারা ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহণে আগ্রহী নয়। তাই ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কৃষক ও বিপণন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ট্রেন চালুর বিষয়ে অনেক ব্যবসায়ী কিংবা চাষিরা অবগত ছিলেন না। এমন কী জানতেন না কৃষি সম্প্রসারণের কোনো কর্মকর্তারাও।
এছাড়া ব্যবসায়ী কিংবা চাষিদের জনমত যাচাই না করে ‘হ-য-ব-র-ল’ সিস্টেমে চালু করা ট্রেন আদৌ টেকসই হবে না বলেও মনে করছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ও ক্যাটল স্পেশাল ট্রেনে লাখ লাখ টাকার লোকসানের পর শনিবার (২৬ অক্টোবর) থেকে চালু হয়েছে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’। আগের মতো এবারও চাষি ও ব্যবসায়ীদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া কীভাবে ক্ষতির মাত্রাকে কমিয়ে আনা যায় বা এড়ানো যায় তার কোন কিছুই নির্ধারণ করা হয়নি।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের সবজি, ফলসহ কৃষিপণ্য ঢাকায় নেওয়ার জন্য এই স্পেশাল ট্রেন চালু হয়। কিন্তু প্রথম দিনেই কৃষিপণ্য ছাড়া রহনপুর ছেড়ে গেছে ট্রেনটি। রহনপুর-ঢাকা রুটে ট্রেনটি মাত্র ১৫০ কেজি সবজি পরিবহণ করছে।
পশ্চিম রেলওয়ের তথ্য মতে, ট্রেনটিতে মোট সাতটি বগি (লাগেজ ভ্যান) রয়েছে। এরমধ্যে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং অপর ছয়টি সাধারণ বগি। অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যানে কৃষিপণ্যের মধ্যে ফল, সবজি ছাড়াও রেফ্রিজারেটেড লাগেজ ভ্যানে মাছ, মাংস ও দুধ পরিবহণ করা যায়। এছাড়া চাষি, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ঢাকায় যাওয়ার জন্য অন্তত ২০টি চেয়ার রয়েছে। সবজির সঙ্গে তাদের বিনা ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে। ট্রেনটির ধারণক্ষমতা ১০ মেট্রিক টন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রহনপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩৪৬ কিলোমিটার। ট্রেনটি পরিবহণ করতে খরচ হয় ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩২। কিন্তু প্রথম দিনে ট্রেনটিতে গেছে মাত্র ১৫০ কেজি ক্যারেট। ফলে ট্রেনটি আয় করেছে মাত্র ৩৬০ টাকা। প্রথম দিনে ট্রেনটিতে লোকসান হয়েছে ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭২ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রহনপুর, রাজশাহী, সরদহ রোড, আড়ানি, আব্দুলপুর, আজিমনগর, ঈশ্বরদী বাইপাস, চাটমোহর কোনোটিতে সবজি বুকিং দেননি কোন চাষী বা ব্যবসায়ী।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, কৃষকের সঙ্গে ঢাকার ব্যবসায়ীদের সমন্বয় ও আবহাওয়া খারাপের কারণে প্রথমদিন সবজি আসেনি। তবে রাজশাহী মহানগর পাইকারি কাঁচাবাজার সমিতির সভাপতি ফাইজুল ইসলাম বলেন, ট্রেনটি আমাদের ব্যবহার করতে পারলে ভালো হতো। তবে ট্রেনটি যে চালু হবে সেটি আমরা জানি না। আমাদের কেউ জানায়নি। রেল বা কৃষি অধিদফতর থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি।
পশ্চিম রেলওয়ের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা একেএম রুহুল আলম জানিয়েছিলেন বলেন, এই ট্রেনটি ধারাবাহিকভাবে কৃষিপণ্য পরিবহন করবে। এখন প্রথম কেবল চালু হয়েছে সময় লাগবে। আমরা কৃষকদেও দোঁড়গোড়ায় গিয়েও প্রচার চালিয়েছি।
সবজি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, সব জায়গাতেই প্রচার প্রচারণা করেছি। আমি নিজে ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডলিতে বাজারে প্রচার করেছিলাম। বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা আশ্বস্ত করেছিলেন পণ্য পাঠানোর। তারা জানিয়েছিলেন প্রতিদিনই ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক ঢাকায় যায়। তবে প্রথম দিনে রাজশাহী পর্যন্ত কোনো সবজি পায়নি। ১৫০ কেজি ডিমের ট্রে (খাঁচা) রাজশাহী থেকে ঢাকা যাচ্ছে। যাতে ৩৬০ টাকায় আদায় হয়েছে। আমরা আশা করছি সামনে এটি ভালো সাড়া ফেলবে।
এদিকে, আম পরিবহণের জন্য ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর চালানো হয় ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন। রাজশাহী থেকে ঢাকা কেজিপ্রতি আম পরিবহণে খরচ পড়ছে দেড় টাকা। কিন্তু এরপরও ট্রেন লোকসানে চলে। সাড়া মেলে না ব্যবসায়ীদের। গত মৌসুমে শুধু যমুনা সেতু বাদ দিয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন ঢাকায় নিয়ে বাড়তি এক লাখ ৫৪ হাজার ৪০৮ টাকা বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে।
রেলওয়ে তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ৪৭ দিন চলাচল করে আয় হয়েছে ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩৬ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ৫৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে ৪৯ দিন চলাচল করে আয় হয়েছে ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৯২৮ টাকা। ব্যয় হয়েছে ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০২২ সালে আয় হয়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ১৭৪ টাকা। আর ব্যয় ১২ লাখ ৪০ টাকা। ২০২৩ সালে আয় হয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫০২ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা। ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৮২ হাজার ৮৬০ টাকা লোকসান হয়েছে। এছাড়া ক্যাটল স্পেশাল ট্রেনেও বছরে লক্ষাধিক টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এতো লোকসানের পরও রেলওয়ের বিশেষায়িত কৃষি ভিত্তিক নব উদ্যোগ সম্পর্কে জানেন না কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কেউ। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা ও আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মাহমুদুল ফারুক বলেন, এ বিষয়ে আমাদেরকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো উপায়েই জানানো হয়নি। তারা জানালে আমরা মাঠ পর্যায়ে জানাতাম। এটা রেলের সমন্বয়য়ের অভাব।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, রেলওয়েতে এমন কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে যারা ব্যক্তি স্বার্থে কোন পরিকল্পনা ছাড়া লোকসানি ট্রেন চালু করে। এতে তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়। কিন্তু সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে চাষি, ব্যবসায়ী, মার্কেটের একটা সুন্দর চেনই ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে। তারপর ট্রেন চালু করতে হবে। এছাড়া যে লক্ষ্যে ওই স্পেশাল ট্রেন চালানো হচ্ছে, তা সফলতা পাবে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিশাত আনজুম অনন্যা জানান, রেল কর্তৃপক্ষ তার সাথে যোগাযোগ করেননি। এমন কি তিনি এ বিষয়ে সামান্যতম অবগত নন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ জানান, বিষয়টা তিনি অবগত। তিনি জানান, রেল কর্তৃপক্ষ হয়তো তেমন প্রচারণা না করার কারণে শাকসবজি পায়নি। ভবিষ্যতে তিনি বিষয়টা দেখবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে পশ্চিম রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস ও মহাব্যবস্থাপক আব্দুল অওয়াল ভুঁইয়ার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও কল রিসিভ করেননি।
সারাবাংলা/ইআ