চাঁদাবাজি-দুর্নীতিতে গণপরিবহণ খাতে নৈরাজ্য: রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৫
ঢাকা: একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে পুরো গণপরিবহণ খাত চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির নৈরাজ্যে পরিণত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।
শনিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। ‘প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার বিষয়ে জাতীয় সংলাপ আয়োজন উপলক্ষে’ এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
সড়ক পরিবহণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী ৭ ও ৮ ডিসেম্বর দুইদিন ব্যাপী একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করবে বলেও জানিয়েছে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ দাবি করেন, ৫৩ বছরের বাংলাদেশে টেকসই সড়ক পরিবহণ কৌশল নেই। সড়ক পরিবহণে আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতার তেমন গুরুত্ব ও প্রয়োগ নেই। একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে গোটা গণপরিবহণ খাত চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির নৈরাজ্যে পরিণত করেছে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক পোশাকের এই গোষ্ঠী গণপরিবহণ খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখে নিজেদের স্বার্থে। কারণ যত বেশি অব্যবস্থাপনা, ততো বেশি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সুযোগ থাকে। তাই রাজধানীর গণপরিবহণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কোম্পানীভিত্তিক বাস পরিচালনার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করছে এই গোষ্ঠী। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে এদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।
সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ ছয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বলে দাবি করেন তিনি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, রাজধানীতে কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করলে রাজধানীর ব্যক্তিগত যানবাহন নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি যানজট কমবে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, যানজট কমলে ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেলের ব্যবহার কমবে। নগরীর সাধারণ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সহজ ও সাশ্রয়ীভাবে যাতায়াত করতে পারবেন। যেহেতু গণপরিবহণের চাঁদাবাজির বিপুল অর্থ রাষ্ট্রের বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়- এ কারণে কোনোভাবেই গণপরিবহণের উন্নতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।
সংগঠনটির চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, যারা গণপরিবহণ পরিচালনার নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তারা রাজধানীর গণপরিবহণ ব্যবহার করেন না। তারা এই ভোগান্তি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেন না। গণপরিবহণ ৫৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহণ করে, আর ব্যক্তিগত যানবাহন মাত্র ১১ শতাংশ যাত্রী পরিবহণ করে। অথচ ব্যক্তিগত যানবাহন ৭০ শতাংশ সড়ক দখল করে চলে। এটা সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য। রাজধানীতে মোটরবাইক ও ব্যক্তিগত যানবাহন নামাতে আইনগত কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাস-মিনিবাস নামাতে রয়েছে নানা বাধা। অনুমোদন লাগে আরটিসির। এটা দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির আরেকটি খাত। আইন করে বন্ধ রাখা হয়েছে সিএনজি অটোরিকশা এবং ট্যাক্সির লাইসেন্স প্রদান। জনবিরোধী এসব সমস্যা সমাধানে বিআরটিএ’র কোন পদক্ষেপ নেই। সক্ষমতার অভাবে বিআরটিএ মূলত লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, অনুপযুক্ত সড়ক, মালিক শ্রেণির অপেশাদারী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় অগনিত মানুষ নিহত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
তিনি বলেন, বিআরটিএ সড়ক পরিবহণ নিয়ন্ত্রণকারী একটি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিস থেকে। যাদের সড়ক বা মোটরযান সম্পর্কিত বাস্তব জ্ঞান থাকে না। ফলে চেয়ারম্যানের পক্ষে সবকিছু জানা-বুঝা সম্ভব হয় না। তাছাড়া তিনি পরবর্তী প্রমোশন পেয়ে অন্যত্র চলে যান। এই পরবর্তী প্রমোশনের আকাঙ্খা কাজ করায় বিআরটিএ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন চিন্তা তার মানসিকতায় কাজ করে না। এসব কারণে আমরা মনে করি, বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হতে হবে সংস্থার ভেতর থেকে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। এছাড়া সড়ক ও মোটরযান বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো একাডেমিশিয়ানকেও চেয়ারম্যান করা যেতে পারে।
একইসঙ্গে চেয়ারম্যান যাতে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারেন এমন বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি থাকতে হবে। চেয়ারম্যানসহ এই বিশেষ জনশক্তির বেতন কাঠামো ভিন্ন হতে পারে। তবে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। চেয়ারম্যান তার দক্ষ জনবলের টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করবেন। সারা দেশের মোটরযান তদারকির লোকবল নেই বিআরটিএ’র। এইসংকটের সমাধান করতে হবে। যেখানে জীবনের প্রশ্ন জড়িত সেখানে সংকট জিইয়ে রাখা যাবে না।
ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার কাজের কোনো সফলতা নেই। তাই সংস্কারের মাধ্যমে ডিটিসিএ কার্যকর করতে হবে। রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বিআরটিএ এবং ডিটিসিএ’র সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) প্রত্যাশিত পরিবহণ সেবা প্রদানে ব্যর্থ। দুর্নীতির কারণে এটা লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দাবিও করেন তিনি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, বিআরটিসি কিছুদিন পরপর নানা ধরনের নতুন বাস ক্রয় করে। এসব বাস অল্প কিছুদিন চলার পর আর রাস্তায় পাওয়া যায় না। মেরামতের অজুহাতে নষ্ট করা হয়। এরপর আবার নতুন বাস ক্রয় করে। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করছে। তাই বিআরটিসি’র কার্যকারিতা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সারা দেশে প্রায় ৫০/৬০ লাখ অটোরিকশা/অটোভ্যান, নসিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদি অনিরাপদ যানবাহন চলছে। এগুলো প্রযুক্তিগতভাবে নিরাপদ করে নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় সড়ক পরিবহণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আগামী ৭ ও ৮ ডিসেম্বর ২ দিনব্যাপী একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই সংলাপে জাতীয় টেকসই পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন, সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ পর্যালোচনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং বিআরটিএ, ডিটিসিএ, বিআরটিসি, সওজ, এলজিইডি-সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে কার্যকারিতা ও জবাদিহিতা নিশ্চিতের কৌশল তৈরি করতে সরকারের নীতি-নির্ধারক, বিশেষজ্ঞ, সড়ক পরিবহণের মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/এনআর/ইআ