আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বাচ্চাদের হ্যান্ড-ফুট অ্যান্ড মাউথ
২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৩
ঢাকা: স্কুল ছুটি শেষে ঘরে আসার পর থেকেই সাড়ে চার বছর বয়সী লাইজা চৌধুরীর মুখ শুকনো আর শরীরের তাপমাত্রা বেশি দেখে তার মা ভাবছিল হয়তোবা গরমের কারণে এমনটা হয়েছে। এর পরেই শুরু হয় লাইজার কিছুই না খাওয়ার বায়না। এমনটা দেখে লাইজার মা আঞ্জুমান আরা ভাবছিলেন হয়তোবা আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে জ্বর আসছে বাচ্চার। আর তাই প্রথমদিকে মা হিসেবে বিশেষ কোনো উদ্বেগ দেখাননি তিনি।
কিন্তু তার চিন্তার মাত্রা বাড়ে যখন লাইজুর জ্বরের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ১০৩ ডিগ্রি। সেইসঙ্গে হাতে, পায়ে ফোস্কা দেখা যাওয়ার কারণে উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। কিন্তু যখন দেখে মুখেও ফোস্কা পড়ে যাওয়ার কারণে কিছু খেতে পারছে না লাইজু, তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে যান আঞ্জুমান আরা। একমাত্র কন্যা লাইজুর খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে মুখে ফোস্কার কারণে। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরে জানতে পারেন লাইজু হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগে আক্রান্ত।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম ও আফরিন দম্পতির একমাত্র সন্তান ৫ বছর বয়সী জিয়াদের মুখে ঘা দেখা দেয়। প্রথমে খাওয়া-দাওয়ায় অনীহার কথা বললেও মুখের ভেতরটা খেয়াল করেনি জিয়াদের বাবা-মা। এরপরে জিয়াদের পায়ের পাতা, হাঁটু, হাতের তালু, কনুইয়ে ফুসকুড়ির মতো কিছু দেখতে পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন জাহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী। প্রথমদিকে জলবসন্ত ভাবলেও খুব দ্রুতই ফুসকুড়ি বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার কারণে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তারা।
চিকিৎসক জানান, জিয়াদ যে রোগে আক্রান্ত তার নাম হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ। এটি নানাভাবে ছড়াতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম হলো স্কুলে অন্য কোনো হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজে আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে আসা।
হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ কী
দেশের বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ হলো একটা ভাইরাল ইনফেকশন ডিজিজ। এটার জন্য দায়ী মূলত কক্সেকি ভাইরাস। কারও যদি এটা হয়ে থাকে তবে তার সংস্পর্শে আসলে অন্যদের মাঝে এটা ছড়াতে পারে।
আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি কাদের
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন জানিয়েছে, সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা হ্যান্ড–ফুট–মাউথ রোগে আক্রান্ত হয়, তবে যে কেউই সংক্রমিত হতে পারে। অসুস্থতা খুব একটা গুরুতর রূপ নেয় না, তবে রোগটি অত্যন্ত সংক্রামক।
হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ যেভাবে ছড়ায়
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ সংক্রমিত কারও সঙ্গে অন্য কেউ হাত মেলালে এটা ছড়াতে পারে। কেউ দেখা গেল নাকে হাত দেওয়ার পরে সেই হাত দিয়েই অন্য কারও সঙ্গে করমর্দন করল, তখনও এটা ছড়াতে পারে। অথবা দেখা গেল, সংক্রমিত কারও সর্দি অন্য কারও গায়ে লাগল, তখনও এটা ছড়াতে পারে। এভাবেই একজনের হ্যান্ড ফুট অ্যান্ড মাউথ সংক্রমিত কারও কাছ থেকে আরেকজনের মাঝে এটা ছড়াতে পারে। রোগটি যেহেতু খুবই সংক্রামক তাই আক্রান্তের সংস্পর্শে এলেই এটা ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথের লক্ষণ বা উপসর্গ কী
হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগের লক্ষণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাঝে অন্যতম হলো হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার জ্বর। পরবর্তী সময়ে শরীরের কিছু স্থানে ফুসকুড়ির মতো দেখা যায়। অনেকে আবার এটাকে দেখে পক্সের মতো মনে করতে পারে।
এই রোগের নাম হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ বলার কারণ হলো এটা শরীরের এই তিন অংশে ছড়াতে পারে। এর মাঝে অন্যতম হলো হ্যান্ড বা হাত যেখানে হাতের তালু কিংবা তালুর পেছনের দিকে এবং কখনো কনুইয়ের দিকে দেখা দিতে পারে। ফুট বা পায়ের তলায় বা গোড়ালির দিকে আবার কখনো কখনো পায়ের উপরের অংশ অর্থাৎ হাঁটুতে এটা দেখা দিতে পারে। আরেকটা হলো মাউথ বা মুখ। এক্ষেত্রে মুখের ভেতরে ক্ষতের মতো দেখা দেয়। জিহ্বা, মাড়ি, গালের ভিতরে এই ক্ষত দেখা দিতে পারে।
তবে হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ বলা হলেও ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি কারো কারো ক্ষেত্রে এটা নিতম্বের দিকেও ছড়াতে পারে। এই জায়গাগুলোতে ফুসকুড়ি উঠে থাকে। এই ফুসকুড়িগুলো উঠলে কখনো কখনো সেসব স্থানে ব্যথা করে বা চুলকায়। তবে মুখের মাঝে যেটা হয় সেটা খুব ভয়ঙ্কর। মুখের ভেতরে হওয়ার কারণে সেখানে জ্বলুনি অনুভব করে, ব্যথা অনুভব করে। এর ফলে চার থেকে পাঁচ দিন খাওয়া-দাওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। হাত, পা যেগুলো উঠে সেগুলো কিছু সময় ব্যথা করে আবার চুলকানি হতে পারে। তবে সেগুলো ধীরে ধীরে কমে আসে। এর পাশাপাশি হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথের উপসর্গগুলোর মাঝে অন্যতম জ্বর, গলা ব্যথা হতে পারে।
হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ যেভাবে ছড়ায়
এই রোগ মূলত ফিকো-ওরাল রুট, নাকের পানি, থুথু ও কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। হাত ও পায়ের র্যাশ হলে সেটার সংস্পর্শেও ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির জামা কাপড়, গ্লাস ব্যবহার করলেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে
এই রোগ থেকে টনসিলাইটিস, ফ্যারিনজাইটিস, ল্যারিনজাইটিস, মেনিনজাইটিস, সেকেন্ডারি স্কিন ইনফেকশন হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধে করণীয়
খাবার আগে ভালোভাবে হাত ধোয়া, বিশুদ্ধ পানি পান করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে চলা, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না যাওয়ার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
অনেকেই ছোট শিশুদের আদর করে চুমু দিয়ে থাকেন। এতেও শিশুরা বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগের ঝুঁকিতে থাকে। তাই এভাবে আদর করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মা-বাবাকে এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সেইসঙ্গে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। ভিটামিন এ, ই ও সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। তাই শিশুদের এসব খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খেলেও শিশুদের ইমিউনিটি বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু অসুখটা শিশুদের মুখের ভেতরেও হচ্ছে, তাই খাবারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বেশি করে তরল খাবার দিতে হবে। এ রোগের কোনো ওষুধ নেই। সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে অসুখটি সেরে যায়। এ সময় প্রচুর পানি পান করাতে হবে। ঢিলেঢালা কাপড় পরাতে হবে বাচ্চাদের। এর পাশাপাশি তাদের হাতের নখ কেটে দিতে হবে। এই সময়টায় শিশুদের আলাদা রাখতে হবে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা, নবজাতক ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষ থেকে আক্রান্তদের দূরে রাখতে হবে।
হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজের চিকিৎসা
দেশের বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, যেহেতু এটা এক ধরণের ভাইরাল জ্বর সে কারণে হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগের চিকিৎসা করতে হবে উপসর্গ দেখে। যদি জ্বর আসে তবে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
যদি চুলকানি থাকে তবে অ্যান্টি হিস্টামিন টাইপ গ্রুপ বা অ্যালার্জি টাইপের ওষুধ খাওয়াবো। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে লোসিও ক্যালামাইন বলে ত্বকের লোশন দেওয়া যেতে পারে চুলকানি কমানোর জন্য।
শিশু যদি ঠিকমতো খেতে পারে, তবে তেমন একটা চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে যদি মুখে বেশি ব্যথা হয়ে থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে সেটা কমানোর জন্য দিনে দুই থেকে তিনবার প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে মুখের ব্যথা কমে আসলে বিশেষ যত্ন নিয়ে খাওয়া-দাওয়া শুরু করতে হয়। এই সময়টাতে স্বাভাবিক খাওয়ার পরিবর্তে ঝাল বা মসলা কম দিয়ে খাওয়ানো প্রয়োজন। এভাবে তিন থেকে চার দিন যদি কন্টিনিউ করা যায় তবে বাচ্চা সেরে উঠবে।
সাধারণ ফ্লুয়ের থেকে হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজকে আলাদা করার উপায় কী
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ সংক্রমিতদের সাধারণত মুখ, পায়ের পাতা, হাঁটুর উপরে, হাতের তালুতে ফোস্কার মতো র্যাশ বেরোয়। অনেক অভিভাবকই শিশুদের মধ্যে এই উপসর্গগুলি দেখে চিকেন পক্সের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। মুখের ভিতরে ফোস্কার মতো র্যাশ বেরোনোর কারণে শিশুদের গলায় বেশ ব্যথা থাকে। ফলে তাদের খাবার গিলতে সমস্যা দেখা দেয়।
চিকিৎসকের মতে, এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলো সাধারণ ভাইরাল জ্বরের মতোই। প্রথম দিকে তীব্র জ্বর, খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া, সারা গায়ে ব্যাথা শুরু হয়। গায়ে র্যাশ বেরুতে শুরু করলেই সচেতন হতে হবে।
আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থেকে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, হ্যান্ড-ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজের সংক্রমণ সরাসরি সংস্পর্শ, আক্রান্ত হওয়ার পর ফুসকুড়ি থেকে বের হওয়া তরল পদার্থ, হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে যে ‘ড্রপলেট’ ছড়ায়, মুখের লালা, সর্দির মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
আর তাই শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। একজন মাধ্যমে আরেকজনের মাঝে যেন এটা ছড়াতে না পারে সেজন্য সবার সতর্ক থাকা জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্কুল বা কোচিং সেন্টারগুলো যেখানে বাচ্চারা বেশি সময় কাটায় সেখানেও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
এই রোগে আক্রান্ত হলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে রোগী খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি।
১. শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি। বড়দের এই রোগের ঝুঁকি কম। ফলে সন্তানকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্বে থাকেন বাবা-মায়েরা। তবু চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্তের সংস্পর্শে যত কম আসা যায়, ততই ভালো। বাড়িতে অন্য শিশু থাকলে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। রোগীর দেখভালের সময় মাস্ক এবং গ্লাভস ব্যবহার করা প্রয়োজন।
২. রোগীর ব্যবহার করা থালা, গ্লাস, বাটি-চামচ পরিষ্কার করার সময় গ্লাভস ব্যবহার করা জরুরি।
৩. রোগীর দেখাশোনার পর সাবান অথবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
৪. এই রোগে আক্রান্ত হলে সাত থেকে ১৪ দিন সারতে সময় লাগে। এই সময় শিশুদের স্কুলে না পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে বাচ্চাকে স্কুলে না পাঠানোই ভালো। এর ফলে একজন বাচ্চার কাছ থেকে আরেকজনের মাঝে এটা ছড়াবে না। এক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষেরও সচেতন হওয়া জরুরি। যদি কোনো বাচ্চার মাঝে এই ধরণের লক্ষণ দেখা যায় তবে তাকে দ্রুত বাসায় পাঠিয়ে দেওয়াটা নিরাপদ।’
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম