কমলার ‘বৈশ্বিক’ বনাম ট্রাম্পের ‘সবার আগে আমেরিকা’— কার জয়ের প্রভাব কী
৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০৪
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন সাম্প্রতিক কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে সংকটময় মুহুর্ত কাটাচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতি। এক দিকে ইউরোপের ইউক্রেন-রাশিয়া, ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইতিহাসের নজিরবিহীন নির্মম ও রক্তাক্ত আগ্রাসন চালাচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তার আগ্রাসন ঘিরে ইতোমধ্যে উত্তপ্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ইরান-ইসরায়েল। অপর দিকে তাইওয়ান ঘিরে উত্তপ্ত দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব এশিয়া।
এর পাশাপাশি অস্থিতিশীলতা ও গৃহ যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদে আক্রান্ত সুদান, মালি, সোমালিয়া, কঙ্গো, বুরকিনা ফাসোসহ আফ্রিকার বহু দেশ। শুধু ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে এসব ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রাজনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এই ধরনের চিন্তাভাবনা করছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী কমলা হ্যারিস জয়লাভ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসের বর্তমানে অনুসৃত নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির খুব একটা পরিবর্তন না-ও হতে পারে। বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতাই অক্ষুণ রাখবেন কমলা হ্যারিস।
তবে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হতে পারে, যদি তার বদলে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এবারের প্রেসিডেন্সিতে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত কয়েক দশকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেটাই প্রমাণিত। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এতদিন ধরে গুরুত্ব পেয়ে আসা ‘বৈশ্বিক নীতি’র বদলে তিনি গ্রহণ করতে পারেন ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতি।
এদিকে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় দৃঢ়ভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প এই ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতির পক্ষে খোলাখুলিই নিজের ধারণা তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ তার পররাষ্ট্র, অর্থনীতি ও যুদ্ধনীতি পরিচালিত হবে, ‘আগে আমেরিকা, পরে অবশিষ্ট বিশ্ব’ নীতিতে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ট্রাম্পের এই নীতির অর্থ হচ্ছে যেখানে আমেরিকার স্বার্থ নেই, কিংবা তার স্বার্থ বিঘ্নিত হবে, এ রকম ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে মিত্রদের স্বার্থকেও গুরুত্ব দিবেন না ট্রাম্প। আর ট্রাম্পের এই অবস্থানেই মূলত শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ গুলো। বিশেষ করে ক্রমেই আগ্রাসীরূপ ধারণ করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো।
এ ব্যাপারে কূটনৈতিক মহলে নানাভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকরা নিজেদের উদ্বেগ তুলে ধরে আসছেন এসব দেশের কূটনীতিকরা। তাদের আশঙ্কা হয়তো রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে এমন কোনো বোঝা পড়ায় আসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মাশুল দিতে হবে ইউরোপে আমেরিকার মিত্রদের। পাশাপাশি ব্যবসা ও রাজনীতির ময়দানে স্বাধীন চেতা স্বভাবের হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে ও ওয়াশিংটনের আমলাদের দেখানো পথে না চলে নিজের ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নেবেন। এই ধরনের আশঙ্কাও রয়েছে। ট্রাম্পের এই ’অনিশ্চিত’ স্বভাবের বিষয়টিই মূলত অনেক বেশি আতঙ্কিত করছে ইউরোপের কূটনীতিকদের। ট্রাম্পের আমলে ইউরোপের কাছে আমেরিকা ’ঘনিষ্ঠ মিত্র’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পরিবর্তে ‘অনিশ্চিত মিত্র’ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এই আশঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি হোয়াইট হাউজে আনুষ্ঠানিকভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও গার্ডিয়ান জানিয়েছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ পরিকল্পনার ব্যাপারে ঘরোয়া আলোচনায় নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। পাশাপাশি তিনি যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিউইয়র্কের বিখ্যাত ট্রাম্প টাওয়ারে সাক্ষাৎ করেন। তখন তাকে নিয়ে স্বভাব সুলভ কৌতুক করতে ছাড়েননি ট্রাম্প।
ট্রাম্প এসময় জেলেনস্কির উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এবং একই সঙ্গে আপনি জানেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি যদি জয়ী হই, আমরা খুব দ্রুত এর সমাধানে (ইউক্রেন যুদ্ধ) পৌঁছাতে পারব।’ স্বভাবতই ট্রাম্পের এমন উক্তি পছন্দ হয়নি জেলেনস্কির। বিশেষত ইউক্রেন যখন ব্যাপক রাশিয়ার হামলার মুখোমুখি।
এক ইউরোপীয় কূটনীতিক যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, ‘আমি নিশ্চিত নই, ট্রাম্প কি পুতিনের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবেন, নাকি তিনি মস্কোর ওপর একটা পরমাণু বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নিবেন। মূল সত্যটা হলো একটা ব্ল্যাক বক্স, এবং যদি কেউ বলে যে তার প্রশাসনের ভেতরে কি হচ্ছে, সেটা শুধু তিনি জানেন। তবে তা হবে মিথ্যা।’
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ট্রাম্প নিজেই ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক। সে হিসেবে ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনকে তিনি শেষ পর্যন্ত সমর্থন দিবেন বলেই ধারনা করা হচ্ছে। তবে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত শীতল সম্পর্ক এতে প্রভাব ফেলবে না। একথাও উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে ইসরাইলি সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ইয়োসি মেলমান ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে বলেছেন, ‘নেতানিয়াহুর সাপেক্ষে দেখা হলে, ট্রাম্পের রেকর্ড অনুযায়ী তাকে খুব কট্টর ইসরায়েলি সমর্থক হিসেবে দেখা যাবে না। আমি এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেব না যে, যখন ট্রাম্প আবির্ভূত হবেন, তখন তিনি ‘গোল্লায় যাও’ এঁটাও বলতে পারেন।’
তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ট্রাম্পের মনোযোগ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তে চীনের দিকে যেতে পারে। নির্বাচনী প্রচারণাতেও বহুবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য চীনকেই দায়ী করে আসছেন ট্রাম্প। তাছাড়া তার সমর্থক রিপাবলিকান শিবিরের অনেকেই শি জিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনকেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। এ ব্যাপারে ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ব্রেইন ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে বলেছেন, ‘আমাদের শিশু ও নাতিদের এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি আসে একটি জায়গা থেকেই। সেই জায়গাটি হচ্ছে বেইজিংয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, এবং শি জিন পিং ও তার উচ্চাভিলাষী মনোভাব।’ ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পও একই ধরনের মনোভাবে আচ্ছন্ন। আমেরিকাকে ফের মহান রাষ্ট্রে পরিণত করতে খোলাখুলি চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত প্রতিটি পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার প্রশাসনে পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক দুই ধরনের বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেতে পারে। এছাড়া ট্রাম্পকে সমর্থনকারী রিপাবলিকান দলের মধ্যেও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে দুই ধরনের মতানৈক্য দেখা যেতে পারে। এরমধ্যে একপক্ষ প্রচলিত রিপাবলিকান চিন্তাধারার অনুসারী। তারা বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকাকে আরও আগ্রাসী এবং শক্তিশালী হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করে। তবে অপর পক্ষ মনে করে বহির্বিশ্বের অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ঝামেলা থেকে দূরে থাকা।
এই মত ধারার অনুসারীদের একজন হলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে উপ-সহকারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী এলব্রিজ কোলবাই। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তাকে ফের হোয়াইট হাউজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দেখা যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এলব্রিজ কোলবাই সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস’কে বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বের পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছি না, আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, গত এক শতকের মধ্যে আমরা এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক রাষ্ট্র নই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম শিল্প শক্তিও নই।’
তবে ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের এধরনের মনোভাবে কমবেশি উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের মধ্যও । ট্রাম্পের এসব নীতি বাস্তবায়ন হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের বন্ধুহীন হয়ে পড়ারও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
এই ব্যাপারে বিখ্যাত থিংক-ট্যাংক কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু ওয়েস গার্ডিয়ান’কে বলেছেন, ‘ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে ফের ফিরে আসার বিষয়টিকে ওয়াশিংটনের পেশাদার কূটনীতিকরাও ভালোভাবে দেখছেন না। তারা দেখেছেন কিভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন বিদেশি নেতার সঙ্গে করমর্দন করেছেন। তারা দেখেছেন, নিজের ব্যক্তি স্বার্থ ও ব্যক্তিগত লেনদেনের ব্যাপারে তিনি কতটা অনিশ্চিত ও দৌদুল্যমান এবং আমাদের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে তিনি কতটা আন্তরিক।’ (বাসস)
সারাবাংলা/এইচআই