শুধু নিজ এলাকা নয়, অন্য এলাকাতেও খোঁজেন টাকার গন্ধ!
৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:২০
ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে সবেমাত্র। এরই মধ্যে সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো সংস্কারে হাত দিয়েছে। কিন্তু যেখানেই হাত দিচ্ছে সেখানেই ফুটে উঠছে লুটপাট আর দুর্নীতির চিত্র। তবে সরকার এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আর দুর্নীতিবাজরা তাদের অপকর্ম ঢাকতে আঁটছে নানান ফন্দি।
অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এদের কেউ কেউ অবশ্য দুর্নীতির পাট চুকিয়ে এখন ঘাপটি মেরে বসে আছেন। কেউ কেউ নিজেকে পরিচয় করাচ্ছেন সাধু হিসেবে। কিন্তু তাদের ভেতরের চিত্রটা ভিন্ন। সম্প্রতি এরকমই এক রাজউক কর্মকর্তার নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে সারাবাংলার অনুসন্ধানে।
মো. সোলাইমান হোসেন। রাজউকের ইমারত পরিদর্শক হিসেবে বর্তমানে মহাখালীতে জোন ৩/২-এ কর্মরত। এর আগে তিনি উত্তরা রাজউক অফিসে বসতেন। তিনি আশুলিয়া এলাকায় জোন ১/৩-এ কর্মরত ছিলেন। বদলি হয়ে এখন মহাখালীতে। কিন্তু এখনো তিনি আশুলিয়া এলাকায় তার অবৈধ কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, আশুলিয়া এলাকায় থাকতেও মহাখালী এরিয়ায়ও তার কর্মতৎপরতা ছিল বলে জানা গেছে।
এদিকে, মহাখালী অফিসে বসতে না বসতেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমে। ৩/২ এলাকা পেয়েই বাড়িওয়ালাদের নোটিশের নামে হয়রানি শুরু করেন। নোটিশ দেওয়ার নামে চলছে তার নীরব চাঁদাবাজি। ৬০ ফিট, মধ্য পীরের বাগ, পাইকপাড়া, কল্যাণপুর এলাকার ভবন মালিকদের কাছে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করেছেন বলে রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে একাধিক অভিযোগ পড়েছে। এসব অভিযোগের কপি সারাবাংলার হাতে এসেছে।
আশুলিয়া এলাকায় থাকতেও ভবন মালিকদের কাছে তিনি ছিলেন মাফিয়া কর্মকর্তা। তার ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পেতেন না। যদিও তিনি নিজেকে ভালো মানুষ সাজাতে সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। এখন মহাখালীতে বদলি হয়ে এলেও আশুলিয়া এলাকায় তার অবৈধ আধিপত্য জারি রয়েছে। এর জোরে তিনি ভবন মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন ঘুষ। এমনকি তিনি অনৈতিক ও আইনবিরোধী কাজেও লিপ্ত আছেন আগের মতো।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আশুলিয়ার বিরুলিয়া ব্রিজ পার হয়ে চারাবাগ বাজারের সঙ্গে কিংশুক হাউজিং ও তার আশে-পাশে নানান অপকর্ম করেছেন সোলাইমান। এছাড়া, ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানির বিল্ডিং তৈরিতে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে দিয়েছেন। চলতি বছরের ৪ জুলাই রাজউকের এলাকা ভাগের আগে সোলাইমান জোন ১/৩-এ কর্মরত থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোন ৩/২-এ ঢুকে এই অপকর্ম করতেন।
কিংশুক হাউজিংয়ের এক বাড়ির মালিক আলাউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিদর্শক সোলাইমান ও অথরাইজড অফিসার নুর আলম ৪০-৫০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। পরে তারা সাত জন বিল্ডিং মালিকের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা ইউসুফ আলী সারাবাংলার এই পরির্দশককে জানান, ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হয়ে ত্রুটিপূর্ণ বাড়িগুলো ভেঙে দিয়েছেন। সেই বাড়িগুলোর কাগজ ঠিক করতে পরিদর্শক সোলাইমান ও অথরাইজড অফিসার নুর আলম বাড়িপ্রতি এক লাখ করে টাকা নিয়েছেন। হাতিয়ে নেওয়া ওই টাকা দিয়ে কিংশুক হাউজিংয়ের আশেপাশে সোলাইমান বাড়িও করেছেন।
একাধিক ব্যক্তি জানান, ইমারত পরিদর্শক সোলাইমান বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে নোটিশের মাধ্যমে উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে এবং তাতেও কাজ না হলে উচ্ছেদ করে অথবা বিল্ডিংয়ের কিছু অংশ ভেঙে দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সোলাইমান ও নুর আলমের এই অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ভবন মালিকরা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট পিটিশনের আশ্রয় নেয়। পরে আদালত ওইসব ভবনে রাজউকের সব কার্যক্রমে স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে, মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বি-ব্লকে বিইএমস ডেভলোপার্স লিমিটেডের ১০ তলা, নুরজাহান রোডের ছয় তলা, একই রোডে হামদান বিল্ডার্স লিমিটেডের ১০ তলা বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্চুতির কারণে রাজউক নোটিশ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সাহায্যে উচ্ছেদ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি ভবন মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নেন। এর পর আগের নকশাতেই ওইসব ভবন নির্মাণ করা হয়।
অনুসন্ধানের যাবতীয় তথ্য ভিডিও এবং অডিও আকারে সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমারত পরিদর্শক সোলাইমানকে ফোন কেটে দিয়ে এই প্রতিবেদকের মোবাইল নাম্বার ব্লক করে দেন। এর পর ওই নাম্বারের হোয়াটসঅ্যাপে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে ম্যাসেজ পাঠালেও এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি। একইভাবে অথরাইজড অফিসার নুর আলমকে কল করা হলে তার বিষয়টি জানা নেই বলে জানান।
এ বিষযে জানতে রাজউক প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) মোমিন উদ্দিনকে কল করা হলে তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার অভিযোগের বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘যার নামেই অভিযোগ পড়ুক না কেন, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের বিষয়গুলো পরিচালক (প্রশাসন) দেখে থাকেন। জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম